২২ শ্রাবণ বাঙালির কাছে শুধু একটি তারিখ নয়—এটি এক অপূরণীয় শূন্যতার দিন। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে বাংলা সাহিত্যের রবি অস্ত গেলেন—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—যিনি শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন এক সভ্যতার পথপ্রদর্শক। তিনি বাংলা ভাষাকে তার সর্বোচ্চ সম্ভাবনায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, মানুষকে চিনিয়েছিলেন নিজের চোখে, আত্মাকে দিয়েছিলেন কণ্ঠস্বর। সেই কণ্ঠ থেমে যাওয়ার দিনটি যেন এক মহাশূন্যতার আহ্বান।
কবি নিজেই লিখে গিয়েছিলেন, ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’—মৃত্যুকে সমকক্ষ করে দেখা, আত্মিক সম্পর্কের দৃষ্টিতে চূড়ান্ত প্রস্থান—এ কেবল রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব ছিল। মৃত্যু কখনোই তাঁকে ভীত করেনি; বরং তিনি মৃত্যুর ভেতরেই খুঁজে পেয়েছিলেন শান্তি, মুক্তি, এমনকি প্রেমের উপাসনা। ‘শেষ লেখা’য় তিনি লিখেছেন, ‘চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছি, দাঁড়িয়ে চেয়ে দেখি প্রাণপণে এ ভুবনকে শেষবারের মতন।’ কত সহজে, অথচ কত অসীম গভীরতায় তিনি বিদায় নিয়েছিলেন—আতঙ্ক নয়, এক আত্মপ্রসার।
মৃত্যুর আগে সেই কবিই লিখেছিলেন—‘শেষ গান গেয়ে গেলেম, আমার খেলা শেষ হয়ে এল।’ এমন সরল, গভীর এবং দীপ্ত উচ্চারণ বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই। তিনি যে কেবল কবি ছিলেন, তা নয়। তাঁর সৃষ্টিকর্মের বিস্তার এতই ব্যাপক যে তাঁকে একক কোনো পরিচয়ে বাঁধা চলে না। তিনি গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখেছেন; গান বেঁধেছেন; চিত্রাঙ্কনে ডুবেছেন; দর্শনে প্রবেশ করেছেন; চিঠিতে জাগ্রত করেছেন সময়ের আত্মা। সর্বোপরি, বাংলা ভাষার হৃদয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন এমন এক সত্তা, যা আজও প্রতিদিন আমাদের সঙ্গে বেঁচে থাকে, কথা বলে, মুগ্ধ করে এবং প্রশ্ন তোলে।

তিনি ছিলেন যুগান্তকারী সংস্কারক, যিনি সমাজকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং কখনোই চিরাচরিত ভাবনার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। যখন ব্রিটিশ রাজ আমাদের আত্মমর্যাদা কেড়ে নিচ্ছিল, তিনি বলেছিলেন, ‘সভ্যতার সংকট উপস্থিত হয়েছে। মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বিস্মৃত হয়েছে।’ এই উপলব্ধিই ছিল তাঁর প্রতিবাদের ভিত্তি। ১৯১৯-এর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশদের বর্বরতার বিরুদ্ধে তিনি নাইট উপাধি ত্যাগ করেন—এটি কেবল রাজনৈতিক প্রতিবাদ ছিল না; ছিল এক ধরনের নৈতিক জাগরণ, এক আত্মশক্তির প্রকাশ।
তাঁর গান আমাদের চেতনার নিঃশব্দ অনুরণন হয়ে আছে। ভালোবাসায় যেমন গাওয়া হয় ‘আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই’, তেমনই মৃত্যুতে আশ্রয় খোঁজা হয় ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’-এ। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—গানের মাধ্যমে গভীরতম জীবনদর্শন কীভাবে ব্যক্ত করা যায়, যেখানে প্রেম, দর্শন ও জীবনের অনিবার্য অন্তিমতা মিলে একাকার হয়।
তাঁর শিক্ষা-দর্শন ছিল প্রথা ভেঙে নির্মিত এক নতুন স্বপ্ন। শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতী তাঁর শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়; ছিল চিন্তার এক পরম বিস্তৃত মঞ্চ, যেখানে মানুষ শিখত প্রকৃতি, শিল্প ও জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে। তাঁর ভাষায়, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার পরে’—এই পঙ্ক্তি শুধু ভক্তির নয়, ছিল তাঁর আত্মসমর্পণের মন্ত্র। এই মন্ত্রেই তিনি শিক্ষা, শিল্প, মানবতা ও বিশ্বচেতনার অপূর্ব সেতু নির্মাণ করেছিলেন।

তাঁর রাজনীতি ছিল সাংস্কৃতিক ও নৈতিক রাজনীতি। দলীয় রাজনীতির সক্রিয় খেলোয়াড় না হলেও, মানুষের সম্মান ও স্বাধিকার রক্ষায় তিনি ছিলেন নিরন্তর যোদ্ধা। যেখানেই মানুষ অবমানিত হয়েছে, সেখানেই তাঁর কলম দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদের অস্ত্র হয়ে। মৃত্যুর ছায়াময় দিনেও তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট ও দীপ্ত।
তাঁর প্রেম-দর্শন নিছক রোমান্টিক নয়; বরং ছিল মহত্তর জীবনচেতনার অন্তঃসার। ‘তোমারে পেয়েছি আমি হৃদয়-মাঝে’—এই একটি চরণেই তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ঈশ্বর, প্রকৃতি ও প্রেম মানুষের হৃদয়ে একাকার হতে পারে।
তিনি চলে যাওয়ার বহু আগেই যেন লিখে রেখেছিলেন নিজের পুনর্জন্মের কথা: ‘আজ হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে।’ আজ সেই শতবর্ষ প্রায় পেরিয়ে গেছে। আমরা সেই কৌতূহলী পাঠক; প্রতিদিন তাঁকে আবিষ্কার করি—তাঁর গান গাই, কবিতা পাঠ করি, তাঁর দৃষ্টি খুঁজি আমাদের নিত্য সংকটে।

আজও, যখন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ কোনো সৃজন, মনন, শুভবোধ, প্রেম বা বিদ্রোহের কথা ভাবে, তখনই অনুভব করে রবীন্দ্রনাথকে। তিনি সেই নাম, যাকে উচ্চারণ না করেও আমাদের দিন শুরু হয় না, রাত শেষ হয় না।
শেষ বয়সে তাঁর কলমে ছিল নিস্তব্ধ আত্মবোধ, গভীর সংহতি। ‘শেষ লেখা’ পাঠ করলে মনে হয়, কবি জীবনের সব উত্তর পেয়ে গেছেন—‘চেয়ে দেখি প্রাণপণে এ ভুবনকে শেষবারের মতন।’ এই শেষবারের মতন দেখা, এই চাওয়া, এই দ্রষ্টার গভীর দৃষ্টি আমাদের উত্তরাধিকার হয়ে রয়ে গেছে। ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই—যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই’—এটাই ছিল তাঁর অন্তিম আত্মপ্রকাশ। আমরা বলি, হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথ, আপনি যা দেখেছেন, যা পেয়েছেন, যা আমাদের দিয়ে গেছেন—তুলনা তার সত্যিই নেই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, বিশিষ্ট বিশ্লেষক—রাজনীতি ও সমাজনীতি
বিভুরঞ্জন সরকার 


















