১৪ আগস্ট ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কিংবদন্তি কিলো ফ্লাইটের কমান্ডার, প্রাক্তন বিমান বাহিনী প্রধান, এয়ার ভাইস মার্শাল বীর সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম, এসিএসসি (অবঃ) এর ২য় মৃত্যু বার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় পালন করেছে। এ উপলক্ষ্যে বিমান বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি ও ইউনিটের মসজিদসমূহে বাদ যোহর তাঁর জীবনীর উপর আলোকপাত করতঃ বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম, এসিএসসি, জিডি (পি) ০১ আগস্ট ১৯৪৪ সালে তৎকালীন নোয়াখালী (বর্তমানে ফেনী) জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম নূরুল হুদা এবং মাতার নাম মরহুমা আনকুরেন্নেছা বেগম। তিনি আরমানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৬০ সালে পিএএফ পাবলিক স্কুল, সারগোদা, পাকিস্তান হতে মেট্রিকুলেশন ও ১৯৬২ সালে পিএএফ একাডেমি, রিসালপুর, পাকিস্তান হতে এফএসসি এবং ১৯৭৭ সালে এয়ার স্টাফ কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র হতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯ আগস্ট ১৯৬০ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমীতে যোগদান করেন এবং ০১ জুলাই ১৯৬২ সালে জিডি (পি) শাখায় কমিশন লাভ করেন। এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ ছিলেন একজন চৌকস বৈমানিক। চাকুরিকালীন সময়ে তিনি দেশ বিদেশে বিভিন্ন পেশাগত কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং সফলতার সাথে তা সম্পন্ন করেন।
এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম ১৯৭১ সালে দেশপ্রেমের অদম্য চেতনায় মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অর্জন করেন লাল-সবুজের পতাকা। বীর মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন স্কোয়াড্রন লীডার সুলতান মাহমুদের বীরত্বগাঁথা এ মহান ইতিহাসের এক অনুকরণীয় অধ্যায়।
তৎকালীন স্কোয়াড্রন লীডার সুলতান মাহমুদ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অদম্য ইচ্ছায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ২ নং সেক্টরে (মতিনগর ও মেলাঘর) স্থলযুদ্ধে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ১নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। স্থলযুদ্ধে তিনি অদম্য সাহসের সাথে রামগড় থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অসংখ্য দুঃসাহসিক অপারেশন পরিচালনা করেন। গেরিলা কমান্ডার হিসেবে তাঁর পরিচালিত বড় একটি অভিযান হলো চট্টগ্রামের মদুনাঘাটে বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ধ্বংস ও চট্টগ্রাম এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা। এই স্থলযুদ্ধ চলাকালে তিনি শত্রু কতৃক ডান হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন স্কোয়াড্রন লীডার সুলতান মাহমুদ সুস্থ হয়ে ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে নবগঠিত ‘কিলো ফ্লাইট’ এর অধিনায়কত্ব গ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিমান বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি পাইলট ইন কমান্ড হিসেবে ১৯৭১ সালের ০৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে অ্যালুয়েট-III হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেল ডিপো ধ্বংস করে প্রথম বিমান আক্রমণ অভিযানের সূচনা করেন। তাঁর চৌকষ অধিনায়কত্বে কিলো ফ্লাইট স্বল্পসময়ের মধ্যে মোট ৫০টি দুঃসাহসিক বিমান অভিযান সাফল্যের সাথে পরিচালনা করে। তন্মধ্যে তিনি ২৫টি অভিযানে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। আকাশ হতে পরিচালিত এ সকল অভিযানসমূহ শত্রুর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসের পাশাপাশি তাদের মনোবল দুর্বল করে যা আমাদের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন স্কোয়াড্রন লীডার সুলতান মাহমুদ যুগপৎভাবে স্থলযুদ্ধে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা, নবগঠিত বিমান বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান এবং আকাশযুদ্ধে অকুতোভয় আক্রমণ পরিচালনা করার মাধ্যমে দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশাত্মবোধ ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য তৎকালীন স্কোয়াড্রন লীডার সুলতান মাহমুদকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন এবং অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সমূহ পালন করেন। এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ ১৯৮১ সালের ২৩ জুলাই বিমান বাহিনী প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৭ সালের ২৩ জুলাই বর্ণাঢ্য কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তাঁর অনন্য ভূমিকা, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে একটি সুসংগঠিত ও কার্যকরী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা এবং পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে দেশ গঠনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম, এসিএসসি (অবঃ)-কে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৮’-এ ভূষিত করে।
তিনি ৩৬ বছর ২২ দিন অবসর যাপনের পর ১৪ আগস্ট ২০২৩ তারিখে আনুমানিক রাত ০৮:১০ ঘটিকায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর ১৪ দিন। তিনি স্ত্রী, ০১ কন্যা, ০১ পুত্র এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
সারাক্ষণ ডেস্ক 



















