০৫:৪২ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫
নোটিফিকেশন জঞ্জাল সামলাতে অ্যান্ড্রয়েড ১৬–তে এআই সারাংশ ও নতুন কনট্রোল ১৯টি অ–ইউরোপীয় দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থগিত, অনিশ্চয়তায় হাজারো পরিবার ঈশ্বরদীতে ৮টি কুকুরছানা পানিতে ডুবিয়ে হত্যা, প্রাণিজ কল্যাণ আইনে গ্রেপ্তার ১ জয়পুরহাটে বাড়িতে ঢুকে নারীকে কুপিয়ে হত্যা, আহত ভাতিজি ঢাকা–সিলেট মহাসড়কে ট্রাক–পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ২ ঢাকা–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে বাস–ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩ গাজীপুরের শ্রীপুরে অটোরিকশা গ্যারেজে আগুন, পুড়েছে ১৫ যানবাহন “‘অ্যাভাটার: ফায়ার অ্যান্ড অ্যাশ’-এ ‘টাইটানিক’–ধরনের হৃদয়ভাঙা, বলছেন সমালোচকেরা” “আরও গভীর পরিসংখ্যান নিয়ে ফিরলো অ্যাপল মিউজিক ‘রিপ্লে ২০২৫’” “মিইয়ে যাওয়া জিডিপি সংখ্যার আড়ালে অস্ট্রেলিয়ার চাহিদা এখনো ‘গরম’”

তাঁকে ভুলিয়ে দেওয়া কী এত সহজ?

যাঁর নাম উচ্চারণ করলে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের পাতা উন্মোচিত হয়, তাঁকে কী কেউ চাইলেই বিস্মৃতির গহ্বরে ফেলে দিতে পারে? যিনি নিজে ইতিহাসের স্রষ্টা, তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার ধৃষ্টতা কেউ দেখালেও তাতে সফল হওয়া সহজ নয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এমন এক নেতা, যাঁর জীবন কেবল রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং জাতির আশা, বেদনা, লড়াই ও মুক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই মানুষটি অল্প বয়স থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মনোভাবের পরিচয় দেন। তাঁর শৈশব ছিল গ্রামীণ জীবনের সরলতায় ভরা, কিন্তু ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। শেখ মুজিব প্রথমে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়াশোনা করেন, পরে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শিখেছিলেন। ১৯৪০ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তখন উপমহাদেশে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন এবং মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি তুঙ্গে। তরুণ মুজিব মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হন এবং সেখানেই তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার প্রকাশ ঘটে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু অচিরেই পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার বঞ্চনার চিত্র তাঁর সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোতে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাবশালী গোষ্ঠী সব ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে রাখে আর পূর্ব বাংলাকে তারা কেবল কাঁচামালের যোগানদাতা হিসেবে ব্যবহার করে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে তরুণ মুজিব ধীরে ধীরে জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন—উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বাঙালি ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মুজিব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতা। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ছাত্ররা ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। মুজিব তখন কারাগারে বন্দি, কিন্তু সেখান থেকেও তিনি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সহযোদ্ধাদের মনোবল জুগিয়ে যান।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপনকারী ঘটনা। ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ গুলি চালিয়ে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেককে হত্যা করে। শহীদদের খবর কারাগারে থাকা মুজিবের মনকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন, সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের পর মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বিস্তৃত হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় এবং মুজিব গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্র করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে কয়েক মাসের মধ্যেই ভেঙে দেয় এবং মুজিবকে আবার গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনা তাঁর মনে স্পষ্ট করে দেয়, কেন্দ্রীয় ক্ষমতাধর গোষ্ঠী বাঙালির স্বার্থ কখনোই রক্ষা করবে না।

ষাটের দশকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন নতুন মোড় নেয়। ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা ছিল। ছয় দফা ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা একে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রস্তাব হিসেবে চিত্রিত করে, কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষ একে তাদের জীবন-অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পেরে আন্তরিকভাবে সমর্থন জানায়। ছয় দফা ঘোষণার পর মুজিব গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের কাছে এর তাৎপর্য তুলে ধরেন। তাঁর ভাষণ ছিল সহজ, হৃদয়গ্রাহী, কিন্তু যুক্তিসম্পন্ন। তিনি বলতেন, নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতেই গড়ে নিতে হবে। এই রাজনৈতিক প্রচারণা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অস্থির করে তোলে। ১৯৬৮ সালে তাঁকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র প্রধান আসামি করা হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি ভারতের সহায়তায় পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছেন। এই মামলায় তাঁকে সহ ৩৪ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে সারাদেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ছাত্ররা ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তীব্র জনচাপের মুখে পাকিস্তানি সরকার মামলা প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়। মুক্তির পর রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব জয় লাভ করে। ৩০০ আসনের মধ্যে তারা ১৬০-এর বেশি আসন পেয়ে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানান। আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ চলতে থাকে, আর এদিকে পাকিস্তানি সেনারা সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানান এবং জনগণকে যার যা কিছু আছে তা নিয়েই প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি বলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এই ভাষণ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার পথে অনিবার্যভাবে এগিয়ে দেয়।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়ে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তাঁকে রাষ্ট্রপতি করেই এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করেই প্রবাসী সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে যুদ্ধ চলে। নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুনর্গঠনের দায়িত্ব ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। তিনি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন, যাতে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু দুর্নীতি, প্রশাসনিক জটিলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।

১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাদ্যসংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মজুতদারদের অপকর্মের কারণে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। সরকার ত্রাণ কার্যক্রমে সমালোচিত হয়। এই সংকট মোকাবিলায় এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করেন, যা কার্যত একদলীয় ব্যবস্থা ছিল। যদিও তাঁর যুক্তি ছিল উন্নয়ন ও ঐক্যের স্বার্থে এই পদক্ষেপ, তবু এটি গণতন্ত্রপ্রেমীদের কাছে সমালোচিত হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের অধিকাংশকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কেবল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। এই হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর অন্ধকারময় মুহূর্ত, যা কেবল একজন নেতার জীবনকেই শেষ করেনি, বরং একটি নবজাত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পথকে দীর্ঘদিনের জন্য বদলে দিয়েছে। শেখ মুজিব ছিলেন সাহসী, আপসহীন এবং জনগণের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত এক নেতা। তাঁর শাসনকালে ভুল ও সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি ক্ষমতা ব্যবহার করেননি। তিনি জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

তাঁর জীবন ইতিহাসে একদিকে যেমন অনুপ্রেরণার, অন্যদিকে তেমনি শিক্ষা ও সতর্কবার্তার উৎস হয়ে থাকবে। আবার এটাও ঠিক, শেখ মুজিবকে নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পোষণ করেন, এমন মানুষও দেশে আছেন। শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যার পর তাঁর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা কম হয়নি। কিন্তু সেটা কি সফল হয়েছিল? হাসিনার ওপর ক্ষুব্ধ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ওপর। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, ম্যুরাল বা শিল্পকর্মগুলো তারা ভেঙে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ৩২ নম্বরের বাড়িটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এগুলো কতটুকু স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ থেকে হয়েছে, না কি এগুলোও সংগঠিত অপচেষ্টা, সেটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। তবে শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মতো লোক দেশে পাওয়া যাবে না, এটা কখনো হতে পারে না। যে মানুষটি না জন্মগ্রহণ করলে বাংলাদেশ নামক দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা পেত না, তাঁকে স্মরণ করা বা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো বা না-জানানোর বিষয়টি সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বা নির্ধারিত হওয়ার মতো মূর্খতা আর কিছু হতে পারে না।

কারও প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, কারও জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালন যেকোনো মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট বর্তমান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তাঁর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে একটা পোস্টে লিখেছিলেন, ‘শোক প্রকাশের স্বাধীনতা চাই। কার মৃত্যুতে কে দুঃখিত হবে এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কার দুঃখে কে দুঃখ পাবে বা কার জন্য কে দোয়া করবে এটাও একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এর উপর কোনো রকম রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ হতে পারে না। শোক প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতেই হবে।’

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, বিশিষ্ট বিশ্লেষক – রাজনীতি ও সমাজনীতি

 

জনপ্রিয় সংবাদ

নোটিফিকেশন জঞ্জাল সামলাতে অ্যান্ড্রয়েড ১৬–তে এআই সারাংশ ও নতুন কনট্রোল

তাঁকে ভুলিয়ে দেওয়া কী এত সহজ?

০৮:০৫:২৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৫

যাঁর নাম উচ্চারণ করলে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের পাতা উন্মোচিত হয়, তাঁকে কী কেউ চাইলেই বিস্মৃতির গহ্বরে ফেলে দিতে পারে? যিনি নিজে ইতিহাসের স্রষ্টা, তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার ধৃষ্টতা কেউ দেখালেও তাতে সফল হওয়া সহজ নয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এমন এক নেতা, যাঁর জীবন কেবল রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং জাতির আশা, বেদনা, লড়াই ও মুক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই মানুষটি অল্প বয়স থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মনোভাবের পরিচয় দেন। তাঁর শৈশব ছিল গ্রামীণ জীবনের সরলতায় ভরা, কিন্তু ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। শেখ মুজিব প্রথমে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়াশোনা করেন, পরে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শিখেছিলেন। ১৯৪০ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তখন উপমহাদেশে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন এবং মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি তুঙ্গে। তরুণ মুজিব মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হন এবং সেখানেই তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার প্রকাশ ঘটে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু অচিরেই পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার বঞ্চনার চিত্র তাঁর সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোতে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাবশালী গোষ্ঠী সব ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে রাখে আর পূর্ব বাংলাকে তারা কেবল কাঁচামালের যোগানদাতা হিসেবে ব্যবহার করে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে তরুণ মুজিব ধীরে ধীরে জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন—উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বাঙালি ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মুজিব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতা। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ছাত্ররা ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। মুজিব তখন কারাগারে বন্দি, কিন্তু সেখান থেকেও তিনি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সহযোদ্ধাদের মনোবল জুগিয়ে যান।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপনকারী ঘটনা। ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ গুলি চালিয়ে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেককে হত্যা করে। শহীদদের খবর কারাগারে থাকা মুজিবের মনকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন, সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের পর মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বিস্তৃত হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় এবং মুজিব গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্র করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে কয়েক মাসের মধ্যেই ভেঙে দেয় এবং মুজিবকে আবার গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনা তাঁর মনে স্পষ্ট করে দেয়, কেন্দ্রীয় ক্ষমতাধর গোষ্ঠী বাঙালির স্বার্থ কখনোই রক্ষা করবে না।

ষাটের দশকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন নতুন মোড় নেয়। ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা ছিল। ছয় দফা ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা একে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রস্তাব হিসেবে চিত্রিত করে, কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষ একে তাদের জীবন-অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পেরে আন্তরিকভাবে সমর্থন জানায়। ছয় দফা ঘোষণার পর মুজিব গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের কাছে এর তাৎপর্য তুলে ধরেন। তাঁর ভাষণ ছিল সহজ, হৃদয়গ্রাহী, কিন্তু যুক্তিসম্পন্ন। তিনি বলতেন, নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতেই গড়ে নিতে হবে। এই রাজনৈতিক প্রচারণা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অস্থির করে তোলে। ১৯৬৮ সালে তাঁকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র প্রধান আসামি করা হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি ভারতের সহায়তায় পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছেন। এই মামলায় তাঁকে সহ ৩৪ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে সারাদেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ছাত্ররা ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তীব্র জনচাপের মুখে পাকিস্তানি সরকার মামলা প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়। মুক্তির পর রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব জয় লাভ করে। ৩০০ আসনের মধ্যে তারা ১৬০-এর বেশি আসন পেয়ে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানান। আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ চলতে থাকে, আর এদিকে পাকিস্তানি সেনারা সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানান এবং জনগণকে যার যা কিছু আছে তা নিয়েই প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি বলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এই ভাষণ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার পথে অনিবার্যভাবে এগিয়ে দেয়।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়ে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তাঁকে রাষ্ট্রপতি করেই এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করেই প্রবাসী সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে যুদ্ধ চলে। নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুনর্গঠনের দায়িত্ব ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। তিনি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন, যাতে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু দুর্নীতি, প্রশাসনিক জটিলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।

১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাদ্যসংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মজুতদারদের অপকর্মের কারণে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। সরকার ত্রাণ কার্যক্রমে সমালোচিত হয়। এই সংকট মোকাবিলায় এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করেন, যা কার্যত একদলীয় ব্যবস্থা ছিল। যদিও তাঁর যুক্তি ছিল উন্নয়ন ও ঐক্যের স্বার্থে এই পদক্ষেপ, তবু এটি গণতন্ত্রপ্রেমীদের কাছে সমালোচিত হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের অধিকাংশকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কেবল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। এই হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর অন্ধকারময় মুহূর্ত, যা কেবল একজন নেতার জীবনকেই শেষ করেনি, বরং একটি নবজাত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পথকে দীর্ঘদিনের জন্য বদলে দিয়েছে। শেখ মুজিব ছিলেন সাহসী, আপসহীন এবং জনগণের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত এক নেতা। তাঁর শাসনকালে ভুল ও সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি ক্ষমতা ব্যবহার করেননি। তিনি জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

তাঁর জীবন ইতিহাসে একদিকে যেমন অনুপ্রেরণার, অন্যদিকে তেমনি শিক্ষা ও সতর্কবার্তার উৎস হয়ে থাকবে। আবার এটাও ঠিক, শেখ মুজিবকে নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পোষণ করেন, এমন মানুষও দেশে আছেন। শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যার পর তাঁর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা কম হয়নি। কিন্তু সেটা কি সফল হয়েছিল? হাসিনার ওপর ক্ষুব্ধ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ওপর। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, ম্যুরাল বা শিল্পকর্মগুলো তারা ভেঙে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ৩২ নম্বরের বাড়িটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এগুলো কতটুকু স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ থেকে হয়েছে, না কি এগুলোও সংগঠিত অপচেষ্টা, সেটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। তবে শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মতো লোক দেশে পাওয়া যাবে না, এটা কখনো হতে পারে না। যে মানুষটি না জন্মগ্রহণ করলে বাংলাদেশ নামক দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা পেত না, তাঁকে স্মরণ করা বা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো বা না-জানানোর বিষয়টি সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বা নির্ধারিত হওয়ার মতো মূর্খতা আর কিছু হতে পারে না।

কারও প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, কারও জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালন যেকোনো মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট বর্তমান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তাঁর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে একটা পোস্টে লিখেছিলেন, ‘শোক প্রকাশের স্বাধীনতা চাই। কার মৃত্যুতে কে দুঃখিত হবে এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কার দুঃখে কে দুঃখ পাবে বা কার জন্য কে দোয়া করবে এটাও একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এর উপর কোনো রকম রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ হতে পারে না। শোক প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতেই হবে।’

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, বিশিষ্ট বিশ্লেষক – রাজনীতি ও সমাজনীতি