প্রাচীন ঐতিহ্যের সূচনা
শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা পুরান ঢাকায় বহু শতাব্দী ধরে পালিত হয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, মুঘল আমল থেকেই ঢাকার সনাতন হিন্দু সম্প্রদায় এই শোভাযাত্রার আয়োজন করে আসছে। তৎকালীন এটি ছিল ভক্তি ও ভজন-গানের মিছিল, যা মূলত শাঁখারি বাজার, টিকাটুলি ও ঢাকার পুরনো মহল্লাগুলো ঘিরেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখনকার দিনে শোভাযাত্রা মূলত ধর্মীয় আচার ও ভক্তিমূলক প্রদর্শনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও এর সামাজিক গুরুত্ব ছিল ব্যাপক।
ঔপনিবেশিক আমলে বিস্তার
ব্রিটিশ আমলে পুরান ঢাকার জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। শাঁখারি বাজার, তাঁতিবাজার, সূত্রাপুর ও লক্ষ্মীবাজার হয়ে শোভাযাত্রা বের হতো। ঢাকার হিন্দু সমাজ তখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রকাশ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। তৎকালীন ইংরেজ প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই এ ধরনের উৎসব আয়োজিত হতো। এই সময়েই শোভাযাত্রায় রথ, প্রতীকী দেবালয়, রঙিন সাজসজ্জা এবং ঢাক-ঢোলের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

পাকিস্তান আমলে সীমাবদ্ধতা
১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও পরে পাকিস্তান আমলে ঢাকার জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা নানা সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের কারণে শোভাযাত্রার পরিসর অনেকটা ছোট হয়ে যায়। তবে শাঁখারি বাজারের হিন্দু সম্প্রদায় তাদের শতবর্ষী ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। সীমিত পরিসরে হলেও প্রতিবছর রথযাত্রার ধাঁচে জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
স্বাধীনতার পর পুনর্জাগরণ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা নতুন মাত্রা পায়। ১৯৭৬ সালে ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মাষ্টমীর কেন্দ্রীয় শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর থেকে এটি রাজধানীজুড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশে পরিণত হয়। পুরান ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে পুরো ঢাকা শহরে হাজারো মানুষ এদিন অংশ নেন। মিছিল ঘিরে ঢাকেশ্বরী মন্দির এলাকায় এক ধরনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
আধুনিক কালে বৈশ্বিক স্বীকৃতি

বর্তমানে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা শুধু পুরান ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব নয়, বরং সারা দেশের একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক আয়োজনে পরিণত হয়েছে। ইউনেস্কো ২০১৬ সালে এটিকে “অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আলোচনা শুরু করে, যা এই উৎসবের আন্তর্জাতিক গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
শোভাযাত্রার মূল বৈশিষ্ট্য
পুরান ঢাকার জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে শুরু হয়ে বংশাল, নবাবপুর, সূত্রাপুর হয়ে আবার মন্দিরেই ফিরে আসে। শোভাযাত্রায় থাকে প্রতীকী রথ, শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার প্রতিমা, বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের নাট্যরূপ, ঢাক-ঢোল, শঙ্খ, উলুধ্বনি, ধর্মীয় পতাকা এবং হাজারো ভক্তের পদযাত্রা। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নারী-পুরুষ-শিশু সকলে সমানভাবে অংশ নিচ্ছেন, যা এ উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা কেবল একটি ধর্মীয় মিছিল নয়, বরং এটি পুরান ঢাকার বহুত্ববাদী ঐতিহ্য, সম্প্রীতি ও সামাজিক সংহতির প্রতীক। প্রতিবছর এ শোভাযাত্রায় শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নয়, মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মের মানুষও সহযোগিতা করেন। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলো নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে।

প্রবীণদের স্মৃতিচারণা ও সাক্ষাৎকার
শাঁখারি বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী সুনীল চক্রবর্তী
“আমার ছোটবেলায়, প্রায় সত্তরের দশকে, শাঁখারি বাজার দিয়ে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা যেত। তখন এত আলো-সাজ ছিল না, কিন্তু ভক্তির আবেগ ছিল প্রবল। আমরা সবাই হাতে মাটির প্রদীপ ধরতাম, শঙ্খ বাজাতাম। পুরো মহল্লা আলোয় ভরে উঠত। মুসলিম প্রতিবেশীরাও মিছিলে পানি দিতেন, কেউ কেউ মিষ্টি বিতরণ করতেন।”
লক্ষ্মীবাজারের গৃহিণী চন্দ্রাবতী দেবী
“পাকিস্তান আমলে শোভাযাত্রা ছিল অনেক সীমিত। পুলিশের ভয়ে বড় করে আয়োজন করা যেত না। আমরা মহিলারা জানালার আড়াল থেকে দেখতাম। স্বাধীনতার পর ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে যখন শোভাযাত্রা শুরু হয়, তখন মনে হয়েছিল আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে এসেছে।”

সূত্রাপুরের প্রবীণ শিক্ষক অমরেশ মুখার্জি
“সত্তর ও আশির দশকে শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ ছিল পৌরাণিক নাট্যরূপ। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা কৃষ্ণ-রাধা সাজত। তখন রঙিন কাপড় পাওয়া দুষ্কর হলেও স্থানীয়রা অনেক ভালোবাসা দিয়ে সাজসজ্জা করতেন। শোভাযাত্রা শেষে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ভোগ দেওয়া হতো, আমরা সবাই মিলে তা গ্রহণ করতাম।”
বংশালের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ (মুসলিম অংশগ্রহণকারী)
“আমি মুসলমান, তবে ছোটবেলা থেকেই জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা আমাদের পাড়ায় এলে আনন্দ করতাম। আমরা মুসলিম ছেলেরা পানির বোতল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতাম, ভক্তদের পানি খাওয়াতাম। আসলে এই উৎসব শুধু হিন্দুদের নয়, পুরান ঢাকার মিলনমেলার প্রতীক।”
এভাবে প্রবীণদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা পুরান ঢাকার জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রাকে আরও ঐতিহাসিক ও হৃদয়স্পর্শী করে তোলে। এটি শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং একটি সামাজিক ঐতিহ্য, যা ঢাকার বহুসংস্কৃতির সাক্ষী হয়ে আছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















