০৮:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
জাহানারা আলমের অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করবে বিসিবি সংবিধান সংশোধন অবশ্যই জনগণের মতামতের ভিত্তিতে হতে হবে: ড. কামাল টাইফুন কালমায়েগির ধ্বংসের মাঝেই ব্রাজিলে শুরু হলো কপ৩০ পূর্ব সাগরে উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ, প্রতিবেশীদের উদ্বেগ লক্ষ্মীপুরে আগুনে পুড়ে গেছে ১৫টি দোকান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় অটোরিকশাচালকসহ দুইজন নিহত আন সি-ইয়ং-এর অসামান্য ব্যাডমিন্টন রেকর্ড, ঐতিহাসিক সিজনে ৯৫% জয় হারানোর লক্ষ্য চট্টগ্রামে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে আহত প্রতিবন্ধী অটোরিকশাচালক পাঁচ ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার সুযোগ নেই: বাংলাদেশ ব্যাংক গলাচিপায় বিএনপি-গণঅধিকার সংঘর্ষে আহত ১৫ জন

ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রেলপথ: ঔপনিবেশিক শাসনের নতুন অধ্যায়

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার বিকাশ শুরু হয়। এ সময় ইংরেজরা শুধু বাণিজ্য ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্যই নয়, বরং তাদের শিল্পপণ্যের বাজার বিস্তার ও কাঁচামাল সহজে পরিবহনের জন্যও রেলপথ নির্মাণে মনোযোগ দেন। এই উদ্যোগ ছিল ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা।

প্রথম রেল যাত্রার সূচনা

১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল ভারতের প্রথম যাত্রীবাহী রেলগাড়ি মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) থেকে থানে পর্যন্ত যাত্রা শুরু করে। প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই যাত্রা ইতিহাসের এক মাইলফলক হয়ে ওঠে। এই ট্রেনের ইঞ্জিনটি ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। ছয়টি কামরায় প্রায় ৪০০ যাত্রী নিয়ে সকাল ৩টায় মুম্বাইয়ের বোরিবন্দর থেকে যাত্রা করে।

ট্রেনটিতে যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ কর্মকর্তারা, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা এবং ইউরোপীয় বণিকেরা। এই প্রথম ভারতবাসী আধুনিক রেল পরিবহনের স্বাদ পায়।

নির্মাণ ও কারিগরি প্রেক্ষাপট

প্রথম রেলপথটি নির্মাণ করে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে কোম্পানি (GIPR)। ব্রিটিশ সরকার কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে এই প্রকল্প চালু করে। রেললাইন বসানো, ইঞ্জিন ও কোচ আমদানি, ব্রিজ নির্মাণ—সবকিছুতে ইংল্যান্ডের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় শ্রমিকরা কঠিন পরিশ্রমে রেললাইন বসালেও তাদের যথাযথ স্বীকৃতি তেমনভাবে দেওয়া হয়নি।

রেল যোগাযোগের প্রভাব

প্রথম রেল চলাচল ভারতের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।

 অর্থনৈতিক দিক: কৃষিপণ্য, কাঁচামাল ও শিল্পপণ্য সহজে বন্দর পর্যন্ত আনা সম্ভব হয়। তুলা, পাট ও চা–জাত দ্রব্য ইংল্যান্ডে রপ্তানি দ্রুততর হয়।
প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ: ব্রিটিশ সেনা দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানো সম্ভব হয়। ফলে বিদ্রোহ দমনে রেল কার্যকর ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়।
সামাজিক পরিবর্তন: দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে শুরু করে। তীর্থযাত্রীদের ভ্রমণ সহজ হয়। তবে নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জন্য আলাদা কামরার মাধ্যমে সামাজিক বিভাজনও স্পষ্ট ছিল।

সমালোচনা ও বিতর্ক

রেলপথ নির্মাণকে ঘিরে একদিকে যেমন প্রশংসা হয়েছিল, অন্যদিকে সমালোচনাও কম হয়নি। অনেক ভারতীয় বিদ্বান মনে করতেন, রেল কেবল ব্রিটিশদের স্বার্থেই কাজ করছে—কারণ এটি ভারতের সম্পদ সহজে লুট করে ইংল্যান্ডে পাঠাতে সাহায্য করছে। আবার রেল নির্মাণের জন্য বিপুল জমি অধিগ্রহণ ও স্থানীয় মানুষের শ্রমশক্তির শোষণও তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়।

উত্তরাধিকার

১৮৫৩ সালের সেই প্রথম যাত্রার পর থেকে রেলওয়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। কয়েক দশকের মধ্যেই ভারত হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রেল নেটওয়ার্কের অধিকারী। আজও ভারতের রেলব্যবস্থা সেই ঔপনিবেশিক উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বহন করছে, যদিও এখন তা স্বাধীন ভারতের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ।

পরিবহনের নতুন অধ্যায়

ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রেলপথ শুধু পরিবহনের নতুন অধ্যায়ই নয়, বরং ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতীকও বটে। এটি ভারতের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার সূচনা করলেও তার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা। তবে ইতিহাস সাক্ষী, সেই প্রথম রেলযাত্রা ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতিকে এক নতুন গতিতে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

জনপ্রিয় সংবাদ

জাহানারা আলমের অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করবে বিসিবি

ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রেলপথ: ঔপনিবেশিক শাসনের নতুন অধ্যায়

০৩:০০:৩২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার বিকাশ শুরু হয়। এ সময় ইংরেজরা শুধু বাণিজ্য ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্যই নয়, বরং তাদের শিল্পপণ্যের বাজার বিস্তার ও কাঁচামাল সহজে পরিবহনের জন্যও রেলপথ নির্মাণে মনোযোগ দেন। এই উদ্যোগ ছিল ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা।

প্রথম রেল যাত্রার সূচনা

১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল ভারতের প্রথম যাত্রীবাহী রেলগাড়ি মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) থেকে থানে পর্যন্ত যাত্রা শুরু করে। প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই যাত্রা ইতিহাসের এক মাইলফলক হয়ে ওঠে। এই ট্রেনের ইঞ্জিনটি ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। ছয়টি কামরায় প্রায় ৪০০ যাত্রী নিয়ে সকাল ৩টায় মুম্বাইয়ের বোরিবন্দর থেকে যাত্রা করে।

ট্রেনটিতে যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ কর্মকর্তারা, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা এবং ইউরোপীয় বণিকেরা। এই প্রথম ভারতবাসী আধুনিক রেল পরিবহনের স্বাদ পায়।

নির্মাণ ও কারিগরি প্রেক্ষাপট

প্রথম রেলপথটি নির্মাণ করে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে কোম্পানি (GIPR)। ব্রিটিশ সরকার কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে এই প্রকল্প চালু করে। রেললাইন বসানো, ইঞ্জিন ও কোচ আমদানি, ব্রিজ নির্মাণ—সবকিছুতে ইংল্যান্ডের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় শ্রমিকরা কঠিন পরিশ্রমে রেললাইন বসালেও তাদের যথাযথ স্বীকৃতি তেমনভাবে দেওয়া হয়নি।

রেল যোগাযোগের প্রভাব

প্রথম রেল চলাচল ভারতের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।

 অর্থনৈতিক দিক: কৃষিপণ্য, কাঁচামাল ও শিল্পপণ্য সহজে বন্দর পর্যন্ত আনা সম্ভব হয়। তুলা, পাট ও চা–জাত দ্রব্য ইংল্যান্ডে রপ্তানি দ্রুততর হয়।
প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ: ব্রিটিশ সেনা দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানো সম্ভব হয়। ফলে বিদ্রোহ দমনে রেল কার্যকর ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়।
সামাজিক পরিবর্তন: দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে শুরু করে। তীর্থযাত্রীদের ভ্রমণ সহজ হয়। তবে নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জন্য আলাদা কামরার মাধ্যমে সামাজিক বিভাজনও স্পষ্ট ছিল।

সমালোচনা ও বিতর্ক

রেলপথ নির্মাণকে ঘিরে একদিকে যেমন প্রশংসা হয়েছিল, অন্যদিকে সমালোচনাও কম হয়নি। অনেক ভারতীয় বিদ্বান মনে করতেন, রেল কেবল ব্রিটিশদের স্বার্থেই কাজ করছে—কারণ এটি ভারতের সম্পদ সহজে লুট করে ইংল্যান্ডে পাঠাতে সাহায্য করছে। আবার রেল নির্মাণের জন্য বিপুল জমি অধিগ্রহণ ও স্থানীয় মানুষের শ্রমশক্তির শোষণও তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়।

উত্তরাধিকার

১৮৫৩ সালের সেই প্রথম যাত্রার পর থেকে রেলওয়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। কয়েক দশকের মধ্যেই ভারত হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রেল নেটওয়ার্কের অধিকারী। আজও ভারতের রেলব্যবস্থা সেই ঔপনিবেশিক উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বহন করছে, যদিও এখন তা স্বাধীন ভারতের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ।

পরিবহনের নতুন অধ্যায়

ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রেলপথ শুধু পরিবহনের নতুন অধ্যায়ই নয়, বরং ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতীকও বটে। এটি ভারতের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার সূচনা করলেও তার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা। তবে ইতিহাস সাক্ষী, সেই প্রথম রেলযাত্রা ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতিকে এক নতুন গতিতে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।