বাংলাদেশে ঘুঘুরা কোলাম্বিফর্মিস (Columbiformes) বর্গের কোলাম্বিডি (Columbidae) পরিবারভুক্ত পাখি। ঘুঘুদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ডাল–পাতা দিয়ে বানানো পাতলা বাসা, সাধারণত ২টি ডিম, মা–বাবা দুজনেই ডিমে তা দেওয়া এবং ছানাকে ‘ক্রপ মিল্ক’ খাওয়ানো। দেশের মাঠ–বসতি–বাগান থেকে পাহাড়ি বন পর্যন্ত নানা আবাসে এদের দেখা মেলে।
বাংলাদেশে কোন কোন ঘুঘু আছে
বাংলাদেশে নিশ্চিতভাবে নথিভুক্ত ঘুঘু প্রজাতি হলো: স্পটেড ডাভ/চিত্রা ঘুঘু (Spilopelia chinensis), লাফিং ডাভ/হাসি ঘুঘু (Spilopelia senegalensis), ইউরেশিয়ান কলার্ড ডাভ (Streptopelia decaocto), রেড-কলার্ড ডাভ (Streptopelia tranquebarica), ওরিয়েন্টাল টার্টল-ডাভ/পূর্বীয় কচ্ছপ-ঘুঘু (Streptopelia orientalis—শীতকালীন অতিথি), এমেরাল্ড ডাভ (Chalcophaps indica—বননির্ভর) এবং বারড কুকু-ডাভ (Macropygia unchall—বিরল, পাহাড়ি বননির্ভর)। অর্থাৎ দেশে কমপক্ষে সাতটি ঘুঘু প্রজাতির উপস্থিতি জানা যায়।
২০০ বছরের প্রেক্ষাপট: তখনকার বিস্তার ও ডাক
ঐতিহাসিক বিবরণ, গেজেটিয়ার, লোককথা ও প্রবচনে চিত্রা ঘুঘু ও কলার্ড ডাভের ডাক গ্রামীণ জীবনের পরিচিত শব্দ। কৃষিভিত্তিক সমতলে ধান–গম–পাটের খেত, গ্রামীণ আঙিনা, ফলের বাগান ও রেলপথ–রাস্তার ধারের বৃক্ষরেখা—এসব জায়গায় ঘুঘুর উপস্থিতি ছিল বিশেষ লক্ষণীয়। পাহাড়ি ও চিরসবুজ বনে এমেরাল্ড ডাভ ও কুকু-ডাভ কম ঘনত্বে থাকত। সময়ের সঙ্গে জমির ব্যবহার বদল, বনভূমি সংকোচন ও শিকার–ফাঁদের চাপ তাদের আবাস ও সংখ্যা—বিশেষত বননির্ভর প্রজাতিগুলো—কমিয়ে দেয়।

বর্তমান অবস্থা—দেশব্যাপী চিত্র
চিত্রা ঘুঘু ও ইউরেশিয়ান কলার্ড ডাভ এখনো শহর–উপশহর–গ্রামে খুব সাধারণ এবং কিছু এলাকায় বাড়তি উপস্থিতি দেখা যায়। লাফিং ডাভ বহু জেলায় শুষ্ক ঝোপঝাড়–খোলা জমিতে ছোট দলে খাবার খোঁজে। রেড-কলার্ড ডাভ উত্তর–পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের উন্মুক্ত সমতলে তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। বিপরীতে, এমেরাল্ড ডাভ ও বারড কুকু-ডাভের মতো বননির্ভর প্রজাতি কেবল সিলেটের লাওয়াছড়া–সাতছড়ি–রেমা–কালেঙ্গা, পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই–থানচি–রুমা–সাজেকের মতো অঞ্চল এবং কিছু উপকূলীয় বনের ভিতরে টিকে আছে। ওরিয়েন্টাল টার্টল-ডাভ শীতে অল্প সংখ্যায় দেখা দেয়।
কোথায় বেশি দেখা মেলে—জেলা/অঞ্চলভিত্তিক ছবি
চিত্রা ঘুঘু, কলার্ড ডাভ ও লাফিং ডাভকে ঢাকার পার্ক–ক্যাম্পাস, চট্টগ্রাম–রাজশাহী–খুলনা–রংপুরে
জীবনচক্র ও আচরণ
ঘুঘুরা সাধারণত পাতলা কঞ্চি–ডাল দিয়ে গাছের শাখা, ঝোপ, খুঁটি বা ভবনের কার্নিশে ১–৬ মিটার উচ্চতায় বাসা বানায়। বছরে একাধিকবার প্রজনন করে; প্রতিবার ২টি ডিম পাড়ে। ডিমে ১৩–১৫ দিন তা দিলে ছানা ফোটে; ১২–২০ দিনের মধ্যে উড়তে শেখে। মা–বাবা দুজনেই ‘ক্রপ মিল্ক’ খাইয়ে ছানাকে বড় করে। খাদ্যাভ্যাসে বীজ–ঘাসের দানা–ফসলের শস্য ও মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র পোকামাকড় থাকে; বেশিরভাগই মাটিতে নেমে খাবার কুড়িয়ে খায়। সকালে ও বিকেলে সক্রিয় এবং দিনভর আলগা দলে ঘোরাফেরা করে।

কেন কমছে—প্রধান কারণ
১) আবাসস্থল হারানো: চিরসবুজ বন, শালবন, গ্রামীণ ফলের বাগান ও ঝোপঝাড় কমে যাওয়া।
২) শিকার–ফাঁদ–বেআইনি বেচাকেনা: গ্রামীণ ও পাহাড়ি অঞ্চলে ঐতিহ্যগত শিকার এখনো চাপ তৈরি করে।
৩) কৃষিজ রাসায়নিক: কীটনাশক–আগাছানাশক বীজভিত্তিক খাদ্যশৃঙ্খলে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৪) নগরায়ণ ও বিড়াল–কাক–শালিকের মতো আক্রমণকারী প্রজাতির চাপ, বিশেষ করে বাসা–ছানায়।
প্রজাতিভিত্তিক সংক্ষিপ্ত নোট
স্পটেড ডাভ (চিত্রা ঘুঘু): সর্বত্র খুব সাধারণ, শহুরে পরিবেশে দারুণ মানিয়ে নিয়েছে।
ইউরেশিয়ান কলার্ড ডাভ: খোলা কৃষিজমি–গ্রামীণ বসতিতে প্রচুর; বিশ্বজুড়েই বিস্তৃত হচ্ছে।
লাফিং ডাভ (হাসি ঘুঘু): শুষ্ক ঝোপঝাড়–খোলা জমিতে ছোট দলে; বীজের সঙ্গে ক্ষুদ্র পোকাও খায়।
রেড-কলার্ড ডাভ: উত্তর–পশ্চিম–মধ্যাঞ্চলের সমতলে তুলনামূলক বেশি; কৃষিজ ভূদৃশ্য পছন্দ।
ওরিয়েন্টাল টার্টল-ডাভ: শীতকালীন অতিথি, সংখ্যায় কম।
এমেরাল্ড ডাভ: ঘন বনভূমির মেঝে–পথে বিচরণ; আবাস হারানোর চাপে স্থানীয়ভাবে হ্রাসমান।
বারড কুকু-ডাভ: পাহাড়ি চিরসবুজ বনে বিরল; টিকে থাকায় বন রক্ষাই মুখ্য শর্ত।
আইনগত অবস্থা ও সংরক্ষণ
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী ঘুঘু শিকার, ফাঁদ পাতা ও বেচাকেনা দণ্ডনীয় অপরাধ। বৈশ্বিকভাবে অধিকাংশ ঘুঘু ‘লিস্ট কনসার্ন’ হলেও বাংলাদেশে বননির্ভর প্রজাতি স্থানীয়ভাবে ঝুঁকিতে। তাই পাহাড়ি ও চিরসবুজ বন, শালবন এবং গ্রামীণ ঝোপঝাড়–বাগান রক্ষা জরুরি।

করণীয়—কীভাবে ঘুঘুদের পাশে দাঁড়াব
১) অবশিষ্ট চিরসবুজ বন ও শালবনে কঠোর সুরক্ষা; ডুমুর–হিজল–করচসহ বীজ–ফলদ গাছ রোপণ।
২) শিকার–ফাঁদের বিরুদ্ধে স্থানীয় নজরদারি ও বিকল্প জীবিকায় সহায়তা।
৩) শহর–গ্রামে সবুজ করিডর, পার্ক–স্কুলে নেস্ট-বক্স/সুরক্ষিত বৃক্ষরেখা।
৪) কৃষিজমিতে কীটনাশকের বিচক্ষণ ব্যবহার ও প্রাকৃতিক নিবাস রেখে চাষাবাদ।
৫) নাগরিক বিজ্ঞানভিত্তিক (eBird ইত্যাদি) নিয়মিত গণনা ও দীর্ঘমেয়াদি মনিটরিং; প্রয়োজন হলে আঞ্চলিক জরিপ।
ডেটা-সীমাবদ্ধতা
দেশব্যাপী ঘুঘুদের কোনো একক, সাম্প্রতিক জাতীয় শুমারি নেই। মাঠপর্যায়ের রেকর্ড, গবেষণা নিবন্ধ ও নাগরিক বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করেই বর্তমান অবস্থা আঁকা হয়—তবে তা যথেষ্ট ইঙ্গিত দেয় কোন প্রজাতি স্থিতিশীল, কারা হ্রাসমান এবং কোন এলাকায় সুরক্ষা জরুরি।
বাংলাদেশে অন্তত সাতটি ঘুঘু প্রজাতি পাওয়া যায়। চিত্রা ঘুঘু, ইউরেশিয়ান কলার্ড ডাভ ও লাফিং ডাভ দেশের শহর–গ্রামে এখনো শক্ত অবস্থানে আছে; রেড-কলার্ড ডাভও বহু এলাকায় নিয়মিত। কিন্তু এমেরাল্ড ডাভ ও বারড কুকু-ডাভের মতো বননির্ভর ঘুঘু স্থানীয়ভাবে কমেছে এবং সীমিত আবাসে টিকে আছে; শীতে ওরিয়েন্টাল টার্টল-ডাভ কম সংখ্যায় আসে। আবাসস্থল রক্ষা, শিকার নিয়ন্ত্রণ ও সবুজ করিডর বাড়ানো গেলে চৈত্রের দুপুরের সেই বিষণ্ন কিন্তু পরিচিত ঘুঘুর ডাক বাংলাদেশের আকাশে–বাগানে আরও বহুদিন জেগে থাকবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















