বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গ একসময় ছিল বহুজাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। এখানকার নদী, বন্দর ও গ্রামীণ বাজারগুলোর টানে বহু বিদেশি বণিক আসতেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন আফগানিস্তান থেকে আসা বণিকরা, যাদের বাংলার মানুষ “কাবুলিওয়ালা” নামে ডাকত। তাঁরা শুধু পণ্য বিক্রি করতেন না, বরং দীর্ঘদিনের বিশ্বাস ও সততার জন্য সাধারণ মানুষের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন।
আগমনের পটভূমি
কাবুল ও আফগানিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এই বণিকরা শত শত বছর ধরে ভারতবর্ষে আসতেন। সিল্ক রোড এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে নেমে তাঁরা বাংলায় পৌঁছাতেন। প্রাচীনকালে বাণিজ্যপথের টানে এদেশে এসে বসতি গড়েন, বিশেষত বাংলার গ্রামাঞ্চল, হাট-বাজার ও নগর এলাকায় তাঁরা ব্যবসা করতেন।
ব্যবসার ধরন ও পণ্য
কাবুলিওয়ালাদের প্রধান পণ্য ছিল শুকনো ফল, বাদাম, আখরোট, পেস্তা, কিশমিশ, ছোলা, খেজুর এবং আফগানিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলের নানা মসলা। শুধু তাই নয়, তাঁরা কাপড়, কার্পেট, এমনকি নানা ধরনের অলঙ্কারও বিক্রি করতেন। এদেশের কৃষিজ পণ্য ও চাল-ডালও তাঁরা কিনে নিয়ে যেতেন, ফলে দুই অঞ্চলের মধ্যে এক ধরনের পণ্য বিনিময় হতো।

ব্যবসার ধরণ ও সততা
তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। কাবুলিওয়ালারা প্রায়শই গ্রামের মানুষকে ঋণে পণ্য দিতেন, পরে ধান বা টাকা দিয়ে মানুষ তা শোধ করত। তাঁরা কখনোই প্রতারণা করতেন না, বরং গ্রামীণ সমাজে “কাবুলিওলার কাছে দেনা থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়”—এমনটি প্রচলিত ছিল। তাঁদের সাদাসিধে পোশাক, পাগড়ি, লম্বা দাড়ি ও দেহাতি বাংলায় ভাঙা ভাঙা কথা বলার ধরন মানুষের মনে আলাদা ছাপ ফেলত।
সামাজিক সম্পর্ক ও বিশ্বাস
বাংলার মানুষ কাবুলিওয়ালাদের শুধু ব্যবসায়ী হিসেবে নয়, অতিথি হিসেবেও গ্রহণ করত। তাঁরা প্রায়শই গ্রামে পরিচিত পরিবারে আশ্রয় পেতেন। শিশুদের সঙ্গে গল্প করতেন, কখনো মিষ্টি বা কিশমিশ বিলিয়ে দিতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটি এই সম্পর্ককেই অমর করে তুলেছে, যেখানে এক বালিকা ও এক আফগান বণিকের স্নেহের সম্পর্ক চিত্রিত হয়েছে।

ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা
সুলতানি আমল থেকে শুরু করে মোগল যুগ এবং এমনকি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলেও কাবুলিওয়ালাদের উপস্থিতি ছিল। ঢাকার চকবাজার, পুরান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম—এমন অনেক জায়গায় তাঁরা নিয়মিত ব্যবসা চালাতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বাজারব্যবস্থা গড়ে ওঠায় তাদের সংখ্যা কমে আসে, কিন্তু ১৯৭০-এর দশক পর্যন্তও পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে কাবুলিওয়ালাদের দেখা যেত।
স্থানীয় মানুষ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, কাবুলিওয়ালারা বাংলার অর্থনীতিতে কেবল ব্যবসার যোগসূত্রই তৈরি করেননি, বরং একধরনের সামাজিক সেতুবন্ধনও রচনা করেছিলেন। স্থানীয় প্রবীণদের মতে, গ্রামের মানুষ তাঁদের এতটাই বিশ্বাস করত যে ঋণ লিখে দেওয়ার জন্য কোনো কাগজ-কলমের দরকার হতো না। ইতিহাসবিদ ড. আব্দুল করিম এক গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, কাবুলিওয়ালারা গ্রামীণ অর্থনীতিতে এমন এক আস্থা তৈরি করেছিলেন, যা আজকের ব্যবসায়িক সমাজে বিরল। স্থানীয়দের স্মৃতিতে এখনো রয়ে গেছে তাঁদের স্নেহময় আচরণ এবং মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা।
কাবুলিওয়ালারা কেবল আফগান বণিক নন, তাঁরা বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাঁরা যে বিশ্বাস, সততা ও মানবিক সম্পর্কের দৃষ্টান্ত রেখেছেন, তা আজও মানুষের স্মৃতিতে অমলিন। বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সংস্কৃতিরও দূত ছিলেন, যাদের কারণে আফগানিস্তান ও বাংলার মধ্যে এক অনন্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















