শিশুর মৃত্যুতে পিতার হৃদয়বিদারক আহ্বান
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কদমতলা গ্রামের ইসরাইল উদ্দিন তাঁর ১১ বছরের ছেলে সাকিবুলকে সাপের কামড়ের পর একের পর এক চারটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও জীবনরক্ষাকারী প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) না পাওয়ায় অবশেষে তাঁর ছেলেটি বাবার কোলে মৃত্যুবরণ করে।
ইসরাইল উদ্দিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমি চারটি হাসপাতালে ঘুরেছি, কিন্তু কোথাও প্রতিষেধক পাইনি। শেষে আমার ছেলে আমার কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি—কোনো বাবা যেন আর এভাবে ছেলের মৃত্যু দেখতে না হয়।”
হাসপাতালের অসহায় পরিস্থিতি
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, হরিপুর উপজেলা হাসপাতাল, ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতাল এবং দিনাজপুরের বিরামপুর হাসপাতাল—কোনো প্রতিষ্ঠানেই অ্যান্টিভেনম ছিল না। ফলে চিকিৎসকরা সাকিবুলকে বাঁচাতে ব্যর্থ হন।
একের পর এক মৃত্যু
ঠাকুরগাঁও জেলায় শুধু সাকিবুল নয়, আরও কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন একই কারণে।
পীরগঞ্জের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তারেক
রাণীশংকৈলের কলেজ শিক্ষার্থী মকসেদ আলী
হরিপুরের গৃহবধূ শম্পা রানী
শম্পার স্বামী জিতেন জানান, তিনি স্ত্রীকে হরিপুর, রাণীশংকৈল ও ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালসহ একাধিক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কোথাও প্রতিষেধক পাওয়া যায়নি। হতাশায় শেষে তাঁরা এক ঝাড়ফুঁকের কাছে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেও শম্পাকে বাঁচানো যায়নি।
মৌসুমভিত্তিক বিপদ
বর্ষার সময় নদী-খাল ফুলে ওঠে, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। আশ্রয়ের খোঁজে বিষধর সাপ ঢুকে পড়ে গ্রাম ও বাড়িঘরে। উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁও জেলায় এ মৌসুমি দুর্যোগ অনেক পরিবারের জন্য মৃত্যু ডেকে আনে।
স্থানীয় চিকিৎসক আজমুল হক বলেন, প্রতি বছর বর্ষায় ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন সাপের কামড়ে মারা যায়। হাসপাতালগুলো আগেই অ্যান্টিভেনমের চাহিদা পাঠালেও সরবরাহ বর্ষা শেষে আসে।
কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা
ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন ডা. মো. আনিসুর রহমান স্বীকার করেছেন, জেলার কোনো হাসপাতালে বর্তমানে অ্যান্টিভেনম নেই। তিনি বলেন, “আমরা চাহিদা পাঠিয়েছি, কিন্তু ঢাকা থেকে কোনো সরবরাহ পাইনি। শুনেছি কেন্দ্রীয় মেডিকেল ডিপোতেও সংকট রয়েছে। আমরা বিকল্প পথে কিছু ডোজ আনার চেষ্টা করছি।”
জাতীয় চিত্র
বাংলাদেশে অ্যান্টিভেনম উৎপাদন হয় না। ফলে বিদেশি সরবরাহের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ কারণে প্রায়ই সংকট তৈরি হয়।
২০২৩ সালের এক সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর দেশে প্রায় ৪ লাখ ৩ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন, যাদের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার ৫১১ জন মারা যান।
আদালতের নির্দেশ
গত ১৮ আগস্ট হাইকোর্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে—সারা দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দ্রুত অ্যান্টিভেনমের ব্যবস্থা করতে।
এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশ আসে। রিটে বলা হয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত অন্তত ৩৮ জন মারা গেছেন এবং ৬১০ জন আহত হয়েছেন সাপের কামড়ে।
বর্ষার মৌসুমি দুর্যোগের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরগাঁওসহ উত্তরাঞ্চলে সাপের কামড় এখন প্রাণঘাতী ঝুঁকি হয়ে উঠেছে। হাসপাতালগুলোতে প্রতিষেধকের ঘাটতি থাকায় সাধারণ মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়ছে। বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়রা বলছেন, অ্যান্টিভেনমের সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত না হলে এ ধরনের মৃত্যু আরও বাড়বে।
বর্ষা মৌসুমে সাপের কামড়ে মৃত্যু, ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে নেই প্রতিষেধক
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ০১:৫১:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫
- 70
জনপ্রিয় সংবাদ




















