ভূমিকা
সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পাশাপাশি রয়েছে নানান প্রজাতির সরীসৃপ, যার মধ্যে অজগর বা পাইথন উল্লেখযোগ্য। সুন্দরবনের অজগরগুলো শুধু বনাঞ্চলের খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষা করছে না, বরং জলাভূমি ও স্থলভাগের মধ্যে পরিবেশগত ভারসাম্যও বজায় রাখছে।
সুন্দরবনে অজগরের সংখ্যা
সরকারি বা বৈজ্ঞানিক কোনো নির্দিষ্ট জনগণনায় অজগরের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে বন বিভাগের হিসাবে, সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অরণ্য ও খাল–বিল জুড়ে অজগরের উপস্থিতি যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় জেলে, মৌয়াল ও বনকর্মীরা প্রায়ই অজগর দেখতে পান। গবেষকদের ধারণা, সুন্দরবনে কয়েক হাজার অজগর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করে।

সুন্দরবনে পাওয়া অজগরের প্রজাতি
সুন্দরবনে মূলত দুই প্রজাতির অজগর দেখা যায়। প্রথমত, ভারতীয় অজগর (Python molurus) যা এখানে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত। এরা সাধারণত ১২ থেকে ১৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় এবং বিরল ক্ষেত্রে ২০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছায়। এরা নদীর পাড়, ঘন বন, চরাঞ্চল এবং হরিণের চলাচল করা এলাকায় বেশি দেখা যায়। তাদের প্রধান খাদ্য হরিণ, বুনো শূকর, বানর, পাখি এবং কখনও কখনও গৃহপালিত ছাগল বা কুকুর।
অন্য প্রজাতিটি হলো বার্মিজ অজগর (Python bivittatus)। এটি ভারতীয় অজগরের তুলনায় কিছুটা বিরল হলেও সুন্দরবনের দক্ষিণাঞ্চল ও জলাভূমি এলাকায় পাওয়া যায়। এরা দৈর্ঘ্যে ১৬ থেকে ২২ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। শক্তিশালী সাঁতারু হওয়ায় নদী ও খালের তীরে বাস করতে ভালোবাসে। তাদের খাদ্যের মধ্যে থাকে জলচর পাখি, মাছ এবং মাঝারি আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী।
অজগরের আবাসস্থল
সুন্দরবনে অজগর প্রধানত ঘন বন, নদী–খাল, চরাঞ্চল ও গুল্মঝোপে বসবাস করে। এরা পানির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে, কারণ সেখানেই শিকার বেশি পাওয়া যায়। বাঘ, কুমির ও বড় শিকারি পাখির পাশাপাশি অজগরও এখানে শীর্ষ শিকারিদের মধ্যে অন্যতম।

খাদ্যাভ্যাস ও শিকার কৌশল
অজগর বিষধর নয়। এরা শিকারকে শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে, তারপর ধীরে ধীরে গিলে খায়। একবার বড় কোনো শিকার ধরলে অনেক সপ্তাহ না খেয়েও থাকতে পারে। হরিণ, বানর, বুনো শূকর, পাখি—এসবই তাদের সাধারণ খাবার।
সুন্দরবনে অজগরের ভূমিকা
অজগর সুন্দরবনের খাদ্যশৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা হরিণ ও শূকরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে বনজ উদ্ভিদকে রক্ষা করে। তারা জলচর পাখি ও ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর উপর শিকার চাপ সৃষ্টি করে কৃষিজমি ও অরণ্য রক্ষা করে। তারা বাঘের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী না হলেও খাদ্যের ভারসাম্য বজায় রাখে।
হুমকি ও চ্যালেঞ্জ
যদিও সুন্দরবনে অজগরের সংখ্যা মোটামুটি স্থিতিশীল, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মানুষের সাথে সংঘর্ষ একটি বড় সমস্যা। গৃহপালিত প্রাণী খাওয়ার কারণে গ্রামাঞ্চলে অজগর হত্যা করা হয়। এছাড়া বাসস্থান ধ্বংস আরেকটি বড় হুমকি। চোরাশিকার, বনভূমি ধ্বংস, কয়লা পোড়ানো ও নদী দখলের কারণে এদের আবাসস্থল সংকুচিত হচ্ছে। একই সঙ্গে অবৈধ বাণিজ্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অজগরের চামড়া ও মাংস পাচারের জন্য অবৈধভাবে ধরা হয়, যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য বিপজ্জনক।

সংরক্ষণে করণীয়
অজগর সংরক্ষণের জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রথমত, বন বিভাগের উচিত অজগরের উপর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালানো এবং সঠিক জনসংখ্যা নির্ধারণ করা। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যে অজগর মানুষকে আক্রমণ করে না, বরং বন রক্ষায় ভূমিকা রাখে। তৃতীয়ত, অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। চোরাশিকার দমনে আধুনিক প্রযুক্তি ও বনকর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। চতুর্থত, অজগরের প্রজনন ও আবাসস্থল সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। পাশাপাশি, স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে অজগর সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝানো গেলে তা দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা
স্থানীয় জেলে ও মৌয়ালরা প্রায়ই অজগরের মুখোমুখি হন। তারা বলেন, অজগর সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না। বরং মানুষই আতঙ্কিত হয়ে এগুলোকে হত্যা করে। জেলেদের একজনের মতে, নদীর ধারে মাছ ধরতে গেলে মাঝে মাঝে বিশাল অজগরকে পানিতে সাঁতার কাটতে দেখা যায়। আরেকজন মৌয়াল জানান, মধু সংগ্রহের সময় গুল্মঝোপে হঠাৎ অজগরের মুখোমুখি হতে হয়, তবে অজগর কখনও প্রথমে আক্রমণ করে না। এসব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে মানুষ যদি শান্ত থাকে, তাহলে অজগর মানুষকে ক্ষতি করে না।
সুন্দরবনের ভারতীয় ও বার্মিজ অজগর দুই প্রজাতিই পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে অপরিহার্য। এরা শিকারি প্রাণী হলেও বনের জন্য এক ধরণের প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রক। অজগর রক্ষার মাধ্যমে শুধু সরীসৃপ নয়, পুরো সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ও খাদ্যশৃঙ্খলকে রক্ষা করা সম্ভব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















