০৭:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫
মিয়ানমারের অসম্পূর্ণ সাধারণ নির্বাচন: জানা দরকার পাঁচটি বিষয় জেলগেট থেকে ফের গ্রেপ্তার লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগ নেতা বড়দিন উপলক্ষে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় রাষ্ট্রপতির দেশে ও বিদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে বড় উল্লম্ফন: বাংলাদেশ ব্যাংক আগামীতে ক্ষমতায় এলে মহানবী (সা.)-এর ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করবো: তারেক রহমান বিশ্বজুড়ে স্ট্রিমিং চাহিদায় কোরিয়ান নাটকের রপ্তানি ঊর্ধ্বমুখী শহরে বাড়ছে শিয়ালের উপস্থিতি, নগর পরিবেশে বন্যপ্রাণীর অভিযোজন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় উপকূলীয় শহরের নগর পরিকল্পনায় বড় পরিবর্তন এশিয়ায় উন্নত চিপ উৎপাদন বাড়ায় বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহে পরিবর্তন গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনায় অচলাবস্থা, কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার

চীন-ভারত সম্পর্কের দ্রুত পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ায় এর প্রভাব

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে চীন ও ভারতের সম্পর্ক বরাবরই জটিল। সীমান্ত সংঘাত থেকে শুরু করে বাণিজ্য-যুদ্ধ পর্যন্ত নানা টানাপোড়েন তাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের গতি হঠাৎ ভিন্ন পথে মোড় নিয়েছে। চীন কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভারতের প্রতি ইতিবাচক বার্তা পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে ভারতও প্রযুক্তি ও বাজার উন্মুক্তকরণে নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: দীর্ঘ সংঘাত ও সহযোগিতার সন্ধান

চীন-ভারত সম্পর্ক বোঝার জন্য এর ইতিহাস জানা জরুরি।

১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধ

১৯৬২ সালে হিমালয়ের সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখে তীব্র সংঘর্ষে ভারত পরাজিত হয়। এই যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস ও শীতলতার পরিবেশ তৈরি করে।

গালওয়ান সংঘর্ষ (২০২০)

এরপর দীর্ঘ সময় সীমান্তে অস্থিরতা বজায় থাকলেও ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ পরিস্থিতি আবারও চরমে পৌঁছায়। এতে ভারতের অন্তত ২০ জন সেনা নিহত হয়। এই ঘটনার পর দুই দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক আবারও তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

ব্রিকস সহযোগিতা

অন্যদিকে, অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে তারা ব্রিকস (BRICS) জোটে একসঙ্গে কাজ করছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার এই সংগঠনটি বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থায় পশ্চিমা প্রভাবের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। ব্রিকসের ভেতর ভারতের সঙ্গে চীনের সমন্বয় প্রমাণ করে যে সব অমিলের মধ্যেও সহযোগিতার সুযোগ খোলা রয়েছে।

চায়নার রেয়ার আর্থ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার

চীন দীর্ঘদিন ধরে বিরল মাটি (Rare Earth Elements) রপ্তানিতে ভারতের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল। এগুলো ইলেকট্রনিক্স, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য অপরিহার্য। সম্প্রতি চীন এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় ভারতের শিল্প খাত একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সুযোগ নয়, বরং দুই দেশের পারস্পরিক আস্থার একটি বড় প্রতীক।

 ভারতে টিকটক প্রত্যাবর্তন

ভারতে ২০২০ সালে নিরাপত্তাজনিত কারণে টিকটক-সহ একাধিক চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ হয়েছিল। যদি সত্যিই টিকটক পুনরায় ভারতে কার্যক্রম শুরু করে, তবে এটি হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি ভারতের প্রযুক্তি ও ডিজিটাল বাজারে চীনের পুনঃপ্রবেশ নিশ্চিত করবে এবং দুই দেশের মধ্যে জনসম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও নতুনভাবে গড়ে উঠবে।

ভূরাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা

চীন-ভারত সম্পর্কের এই উষ্ণতা কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।

এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য

এতদিন দক্ষিণ এশিয়ায় চীন–পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ভারতকে প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যে থাকতে হতো। এখন যদি চীন-ভারত ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, তবে পাকিস্তান ভূরাজনীতিতে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ভারতকে চীনের প্রভাব থেকে দূরে রাখতে চেয়েছে। যদি ভারত চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গভীর করে, তবে এটি মার্কিন নীতির জন্য বড় ধাক্কা হবে।

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি

বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলোও চীন-ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতার প্রভাবে নতুন বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ পেতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব

ভারত যদি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এক ধরনের নতুন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠতে পারে। যেমন:

  • অবকাঠামো বিনিয়োগে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়তে পারে।
  • দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংযোগ (কানেক্টিভিটি) আরও শক্তিশালী হতে পারে।
  • ছোট দেশগুলো কৌশলগত প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা থেকে বেশি লাভবান হতে পারে।

চীন-ভারত সম্পর্কের সাম্প্রতিক পরিবর্তন শুধু বাণিজ্যিক বা প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ, গালওয়ান সংঘর্ষ বা ব্রিকস সহযোগিতা—সবকিছু মিলিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক একদিকে সংঘাতময়, অন্যদিকে সহযোগিতার সুযোগে পরিপূর্ণ। রেয়ার আর্থ রপ্তানি, টিকটকের প্রত্যাবর্তন বা অন্য যে কোনো পদক্ষেপই হোক না কেন, এগুলো এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির শক্তির ভারসাম্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে পারে। বিশ্ব রাজনীতির নতুন সমীকরণ তৈরি হওয়ার পথে চীন ও ভারতের এই ঘনিষ্ঠতা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা।

জনপ্রিয় সংবাদ

মিয়ানমারের অসম্পূর্ণ সাধারণ নির্বাচন: জানা দরকার পাঁচটি বিষয়

চীন-ভারত সম্পর্কের দ্রুত পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ায় এর প্রভাব

০৫:৫০:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে চীন ও ভারতের সম্পর্ক বরাবরই জটিল। সীমান্ত সংঘাত থেকে শুরু করে বাণিজ্য-যুদ্ধ পর্যন্ত নানা টানাপোড়েন তাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের গতি হঠাৎ ভিন্ন পথে মোড় নিয়েছে। চীন কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভারতের প্রতি ইতিবাচক বার্তা পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে ভারতও প্রযুক্তি ও বাজার উন্মুক্তকরণে নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: দীর্ঘ সংঘাত ও সহযোগিতার সন্ধান

চীন-ভারত সম্পর্ক বোঝার জন্য এর ইতিহাস জানা জরুরি।

১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধ

১৯৬২ সালে হিমালয়ের সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখে তীব্র সংঘর্ষে ভারত পরাজিত হয়। এই যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস ও শীতলতার পরিবেশ তৈরি করে।

গালওয়ান সংঘর্ষ (২০২০)

এরপর দীর্ঘ সময় সীমান্তে অস্থিরতা বজায় থাকলেও ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ পরিস্থিতি আবারও চরমে পৌঁছায়। এতে ভারতের অন্তত ২০ জন সেনা নিহত হয়। এই ঘটনার পর দুই দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক আবারও তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

ব্রিকস সহযোগিতা

অন্যদিকে, অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে তারা ব্রিকস (BRICS) জোটে একসঙ্গে কাজ করছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার এই সংগঠনটি বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থায় পশ্চিমা প্রভাবের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। ব্রিকসের ভেতর ভারতের সঙ্গে চীনের সমন্বয় প্রমাণ করে যে সব অমিলের মধ্যেও সহযোগিতার সুযোগ খোলা রয়েছে।

চায়নার রেয়ার আর্থ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার

চীন দীর্ঘদিন ধরে বিরল মাটি (Rare Earth Elements) রপ্তানিতে ভারতের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল। এগুলো ইলেকট্রনিক্স, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য অপরিহার্য। সম্প্রতি চীন এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় ভারতের শিল্প খাত একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সুযোগ নয়, বরং দুই দেশের পারস্পরিক আস্থার একটি বড় প্রতীক।

 ভারতে টিকটক প্রত্যাবর্তন

ভারতে ২০২০ সালে নিরাপত্তাজনিত কারণে টিকটক-সহ একাধিক চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ হয়েছিল। যদি সত্যিই টিকটক পুনরায় ভারতে কার্যক্রম শুরু করে, তবে এটি হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি ভারতের প্রযুক্তি ও ডিজিটাল বাজারে চীনের পুনঃপ্রবেশ নিশ্চিত করবে এবং দুই দেশের মধ্যে জনসম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও নতুনভাবে গড়ে উঠবে।

ভূরাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা

চীন-ভারত সম্পর্কের এই উষ্ণতা কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।

এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য

এতদিন দক্ষিণ এশিয়ায় চীন–পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ভারতকে প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যে থাকতে হতো। এখন যদি চীন-ভারত ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, তবে পাকিস্তান ভূরাজনীতিতে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ভারতকে চীনের প্রভাব থেকে দূরে রাখতে চেয়েছে। যদি ভারত চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গভীর করে, তবে এটি মার্কিন নীতির জন্য বড় ধাক্কা হবে।

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি

বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলোও চীন-ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতার প্রভাবে নতুন বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ পেতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব

ভারত যদি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এক ধরনের নতুন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠতে পারে। যেমন:

  • অবকাঠামো বিনিয়োগে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়তে পারে।
  • দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংযোগ (কানেক্টিভিটি) আরও শক্তিশালী হতে পারে।
  • ছোট দেশগুলো কৌশলগত প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা থেকে বেশি লাভবান হতে পারে।

চীন-ভারত সম্পর্কের সাম্প্রতিক পরিবর্তন শুধু বাণিজ্যিক বা প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ, গালওয়ান সংঘর্ষ বা ব্রিকস সহযোগিতা—সবকিছু মিলিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক একদিকে সংঘাতময়, অন্যদিকে সহযোগিতার সুযোগে পরিপূর্ণ। রেয়ার আর্থ রপ্তানি, টিকটকের প্রত্যাবর্তন বা অন্য যে কোনো পদক্ষেপই হোক না কেন, এগুলো এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির শক্তির ভারসাম্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে পারে। বিশ্ব রাজনীতির নতুন সমীকরণ তৈরি হওয়ার পথে চীন ও ভারতের এই ঘনিষ্ঠতা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা।