গৃহযুদ্ধের মধ্যেই প্রথম দফার সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করছে মিয়ানমারের সামরিক শাসকগোষ্ঠী। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর এই প্রথম ভোট হলেও দেশের অর্ধেকের মতো এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক তীব্র হয়েছে।
নির্বাচনের সময়সূচি ও বাস্তবতা
রোববার শুরু হয়েছে নির্বাচনের প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ ১০ জানুয়ারি এবং তৃতীয় ধাপ তার প্রায় দুই সপ্তাহ পর হওয়ার কথা থাকলেও তারিখ এখনো নির্ধারিত হয়নি। মোট ৩৩০টি টাউনশিপের মধ্যে ভোট হচ্ছে ২৭৪টিতে। চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে দেশের বড় অংশে ভোট আয়োজন সম্ভব হয়নি।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইং বলেছেন, ভোটারদের এমন প্রার্থী বেছে নিতে হবে যারা দায়িত্বশীল, জনগণের সেবা করবে এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশের কল্যাণে কাজ করবে। এই বক্তব্য থেকেই নির্বাচনের চরিত্র ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ভোটের কাঠামো ও রাজনৈতিক দল
সারা দেশে ছয়টি রাজনৈতিক দল প্রার্থী দিয়েছে। একক অঞ্চল বা রাজ্যে আরও ৫১টি দল ও কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তবে আগের নির্বাচনের তুলনায় প্রচার ও জনসম্পৃক্ততা অনেক কম। ২০২০ সালের নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও সামরিক বাহিনী ফলাফল মানেনি।

নতুন কঠোর আইন অনুযায়ী পুনরায় নিবন্ধন না করায় অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিসহ ৪০টি দল নিষিদ্ধ হয়েছে। এরপর আরও চারটি দল বাতিল হয়েছে। এবার প্রথমবারের মতো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে, ফলে একক কোনো দলের বড় জয় পাওয়ার সুযোগ সীমিত। তাছাড়া সংসদের ২৫ শতাংশ আসন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত থাকায় ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের দিকেই ঝুঁকে আছে।
গৃহযুদ্ধের মধ্যেই কেন নির্বাচন
বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক সরকার বৈধতা নয়, প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে নির্বাচন করছে। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ফিল রবার্টসনের মতে, মিন অং হ্লাইং মূলত নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চান এবং সম্ভবত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ তৈরি করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তিনি ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে সক্রিয় থাকতে চান।
প্রতিবেশী দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আসিয়ান দেশগুলো সরাসরি এই নির্বাচনকে সমর্থন দেয়নি। তাদের মতে, আগে সহিংসতা বন্ধ করা জরুরি। তবে চীন ও ভারত সীমান্ত স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে এই প্রক্রিয়াকে কিছুটা সমর্থন করছে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন সরকারের বৈধতা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, আন্তর্জাতিক সহায়তা ও মনোযোগ কমে যাওয়ায় মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও মানবিক সংকট আরও গভীর হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষকেই অনেকটা একা লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

বিরোধী পক্ষ ও মানবাধিকার উদ্বেগ
বিরোধী কর্মী ও নাগরিক সমাজ এই নির্বাচনকে প্রহসন বলে আখ্যা দিয়েছে। ডিসেম্বরের শেষে ১৬টি নারী অধিকার সংগঠন যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনকে ভাঁওতা ও প্রতারণা বলে উল্লেখ করে। তাদের মতে, এই প্রক্রিয়া শান্তি বা রাজনৈতিক সমাধান আনতে পারবে না।
চলমান সংঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। রাখাইন রাজ্যে হাসপাতালে বিমান হামলায় বহু মানুষের প্রাণহানির মতো ঘটনা দেখিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থায়ী শান্তি এখনো অনেক দূরে।
ফল ঘোষণা কবে
প্রতিটি ধাপের পর প্রাথমিক ফল প্রকাশের কথা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সব ধাপের চূড়ান্ত ফল জানুয়ারির শেষ নাগাদ পাওয়া যেতে পারে। তবে নির্দিষ্ট তারিখ এখনো ঘোষণা করা হয়নি। সব ফল অনুমোদনের পরই জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে বলে জানানো হয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















