তালেবানরা সম্প্রতি আফগানিস্তানে তাদের ক্ষমতায় ফেরার চার বছর পূর্তি উদযাপন করেছে। তারা আজ শক্ত অবস্থানে রয়েছে—দেশের ভেতরে তাদের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত হয়েছে এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একাধিক সাফল্যও অর্জন করেছে।
রাশিয়া জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশ হয়। আগে মস্কো তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। পাকিস্তান জুনে কাবুলে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়, যদিও ইসলামাবাদ-কাবুলের মধ্যে সম্পর্ক এখনো উত্তেজনাপূর্ণ। ভারতের পক্ষ থেকেও সংবাদমাধ্যমে এসেছে যে, তারা আফগান দূতাবাস আবার চালু করার এবং তালেবান মনোনীত একজন প্রতিনিধি গ্রহণের চিন্তা করছে।
তালেবান এখন তাজিকিস্তান বাদে মধ্য এশিয়ার প্রতিটি দূতাবাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এমনকি তাজিকিস্তানও ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইরানের কাবুলে কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। উপসাগরীয় প্রভাবশালী দেশ কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও সম্পর্ক জোরদার করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত মে মাসে তালেবান দূতকে স্বীকৃতি দেয়।
চীন অনেক দিন ধরেই তালেবানের কাছের মিত্র। ২০২৩ সালে তারা কাবুলে রাষ্ট্রদূত পাঠায় এবং বেইজিংয়ে তালেবান দূতকে গ্রহণ করে। গত আগস্টে কাবুলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের অঙ্গীকার করেন এবং তালেবানকে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগে যুক্ত করার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন। যদিও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, বেইজিং প্রকাশ্যে বলেছে, তালেবানকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বাদ দেওয়া উচিত নয়।
পশ্চিমা সরকারগুলো এখনো তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে অনড়, কিন্তু তবুও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। জাপান ফেব্রুয়ারিতে একটি তালেবান প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানায়। যুক্তরাষ্ট্র মার্চে শীর্ষ তালেবান নেতাদের ওপর ঘোষিত পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয় বলে জানা যায়, একজন মার্কিনি নাগরিক জর্জ গ্লেজম্যানকে মুক্ত করার লক্ষ্যে।
চার বছর পর তালেবান এখন আত্মবিশ্বাসী ও গতিময়। তারা মনে করছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
কিন্তু আফগানিস্তান সহজ দেশ নয়। এখানে নানা জটিল সংকট তালেবানের ক্ষমতা ধরে রাখার পথকে হুমকির মুখে ফেলছে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক মানুষ—প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ—মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয় অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ১ কোটি ২৪ লাখ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ২৯ লাখ মানুষ ২০২৪ সালে চরম ক্ষুধার ঝুঁকিতে। পাঁচ বছরের নিচে সাড়ে তিন মিলিয়ন শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। পানি, আশ্রয়সহ মৌলিক চাহিদার অভাবও তীব্র। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আফগানিস্তানে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে জরুরি ও ব্যাপক পরিমাণে আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে।
অর্থনীতি ভীষণ সংকটে আছে। বিশ্বব্যাংক ধীরগতির পুনরুদ্ধারের কথা বললেও, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, দুর্বল সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি বিনিয়োগের অভাবে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য মারাত্মক পর্যায়ে। পরিবারগুলো সন্তানদের খাওয়াতে পারছে না। কন্যাশিশুদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে, যা সাধারণ আফগানদের হতাশার গভীরতা দেখায়।
নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি তালেবানের নিষ্ঠুর আচরণ অর্থনৈতিক ও মানবিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ১৪ লাখ মেয়েকে মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা এবং বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রে নারীদের কাজ নিষিদ্ধ করার ফলে ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে আফগান অর্থনীতির ক্ষতি হবে ৯২০ মিলিয়ন ডলার। ইউনেস্কো অনুমান করেছে, ২০৬৬ সালের মধ্যে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৯৬০ কোটি ডলার। নারীদের ত্রাণ সংস্থায় কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা অনেক পরিবারকে আয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে এবং অনেকেই জরুরি মানবিক সহায়তাও পাচ্ছে না।
তবে কেবল তালেবানকে দোষ দেওয়া যাবে না। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা আগামী বছরের জন্য আফগানিস্তানে সব ধরনের সাহায্য স্থগিত রাখবে—যার পরিমাণ ১.৭ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং সুইডেনও আফগানিস্তানে সাহায্য কমানোর সংকেত দিয়েছে। বিদেশি সহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল এই দেশটিতে পশ্চিমা সাহায্য বন্ধ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে এবং মানুষের প্রাণহানি ঘটবে।
এর মধ্যেই ইরান ও পাকিস্তান জোরপূর্বক প্রায় ১৯ লাখ আফগান শরণার্থীকে ফেরত পাঠিয়েছে, যা তালেবান সরকারের জন্য আরও বড় সংকট তৈরি করেছে। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, এটি বহুস্তরীয় মানবাধিকার সংকট সৃষ্টি করেছে। ফেরত আসা শরণার্থীদের এক-তৃতীয়াংশ নারী ও মেয়ে, যারা এখন তালেবান শাসনের নিপীড়নের মুখোমুখি হবে। বাকিরা এমন এক দেশে ফিরে যাচ্ছে যেখানে ইতিমধ্যেই চরম দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব এবং মৌলিক চাহিদার অভাব বিরাজ করছে।
এই সংকটগুলোর সমাধানে দক্ষ শাসন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দরকার। কিন্তু তালেবান সরকার এতে আগ্রহী নয়। তাদের লক্ষ্য নারী ও মেয়েদের দমন করা এবং ইসলামের কঠোর ব্যাখ্যাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া—আফগানিস্তান পুনর্গঠন বা জনগণের জীবনমান উন্নত করা নয়।
এভাবে তালেবান টিকে থাকতে পারবে না। আফগানিস্তানের সংকট সমাধানে ব্যর্থতা তাদের বৈধতাকে ক্ষয় করবে, শাসনকে অকার্যকর করে তুলবে এবং অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। পশ্চিমা সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে কেবল নিষ্ঠুরতার ওপর ভর করে টিকে থাকা কোনো সরকারের জন্যই দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব নয়।
ইতিহাসে আফগানিস্তান কখনো শাসকদের প্রতি সদয় ছিল না। অল্প কয়েকজন শাসকই ক্ষমতাচ্যুত বা নিহত হওয়া থেকে বেঁচেছেন। তালেবান নিজেরাও এটি জানে—১৯৯৬ সালে তারা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহকে হত্যা করেছিল এবং ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল, পরে আবার ২০২১ সালের আগস্টে কাবুল দখল করে ফিরে আসে।
তালেবান যখন পঞ্চম বছরে প্রবেশ করছে, এই শিক্ষা তাদের মনে রাখা উচিত, এর আগেই আফগানিস্তানের সংকট যেন অপরিবর্তনীয় ভাঙনের দিকে না যায়।
ক্রিস ফিটজেরাল্ড 


















