বৈশ্বিক তেলের বাজারে নতুন বাস্তবতা
বিশ্ব অর্থনীতি বর্তমানে একটি অস্থির সময় পার করছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে ওপেকপ্লাসের সিদ্ধান্ত মিলিয়ে বৈশ্বিক সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানসহ এশিয়ার বড় দেশগুলো তাদের আমদানি বাড়াচ্ছে। শিল্পের সম্প্রসারণ, বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং কৌশলগত রিজার্ভ পূরণের জন্য তারা ব্যাপক হারে তেল কিনছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে যখন বড় ক্রেতাদের চাহিদা বাড়ে, তখন দামও অনিবার্যভাবে বাড়তে থাকে। ব্রেন্ট ক্রুড, ডব্লিউটিআই কিংবা দুবাই ক্রুড—সব সূচকেই এশীয় চাহিদার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ভারত ও চীনের কৌশল
ভারত ও চীন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল আমদানিকারক। তারা রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে। ভারত প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ ব্যারেল তেল ব্যবহার করে, আর চীন প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ব্যারেল। এই বিপুল চাহিদার কারণে তারা ছাড়ে রাশিয়ান তেল কিনতে সক্ষম হচ্ছে। একই সঙ্গে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকেও বড় চুক্তি করছে।
শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকায় এই দেশগুলো বেশি দামে কিনলেও অর্থনৈতিক আঘাত সামলাতে পারছে। ফলে বিশ্ববাজারে তারা ক্রমশ প্রভাবশালী ক্রেতায় পরিণত হচ্ছে।
দাম বাড়ার শৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া
তেলের দাম বাড়া মানে শুধু জ্বালানির দাম বাড়া নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়, কৃষি ও শিল্পের খরচ। ফলে এক ধরনের কস্ট-পুশ ইনফ্লেশন তৈরি হয়। বড় অর্থনীতিগুলো এ ধাক্কা শোষণ করতে পারলেও দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলো এতে হুমকির মুখে পড়ছে।
বাংলাদেশ: ডলার সংকটে জ্বালানি বাজার
বাংলাদেশ গত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আমদানি বিল পরিশোধে সীমিত ডলার বরাদ্দ করতে হচ্ছে। এর ফলে জ্বালানি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশে দাম বাড়ার ফলে—
- • ঘনঘন লোডশেডিং
- • শিল্পোৎপাদনে ব্যাঘাত
- • পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি
- • নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি বাড়ানো ছাড়া বাস্তবসম্মত কোনো পথ নেই।
পাকিস্তান: ঋণের বোঝা ও আইএমএফ চাপ
পাকিস্তান বর্তমানে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির অধীনে রয়েছে। ঋণের শর্ত অনুযায়ী সরকারকে ভর্তুকি কমাতে হচ্ছে। তেলের দাম বাড়লে এর সরাসরি প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। গত কয়েক মাসে পাকিস্তানে একাধিকবার জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে নিত্যপণ্যের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, তেলের দাম আরও বাড়লে পাকিস্তানের বাজেট ঘাটতি বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি ৩০ শতাংশ ছুঁতে পারে।
মিয়ানমার: কালোবাজারের উত্থান
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার কারণে মিয়ানমার তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। সরকারি আমদানির ঘাটতি পূরণে কালোবাজার কার্যত প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। তেলের দাম বাড়লে এই কালোবাজারে মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়িয়ে তুলবে।
আফগানিস্তান: আমদানিনির্ভর ভঙ্গুর অর্থনীতি
আফগানিস্তানের তেল চাহিদার বড় অংশ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসে। নিজেদের কোনো বড় রিজার্ভ বা পরিশোধনাগার না থাকায় তারা পুরোপুরি বাইরের বাজারের ওপর নির্ভরশীল। দাম বাড়লে পরিবহন, কৃষি এবং খাদ্যদ্রব্যের খরচ সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায়। মানবিক সংকটে থাকা দেশটি আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
লাভবান কারা?
- • তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, রাশিয়া ও ইরান উচ্চমূল্য থেকে সরাসরি লাভবান।
- • শক্তিশালী অর্থনীতি: ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো ছাড়ে তেল কিনে তাদের আমদানির খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখছে।
- • দুর্বল অর্থনীতি: বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও আফগানিস্তান দ্বিগুণ চাপে রয়েছে—একদিকে ডলার সংকট, অন্যদিকে বাড়তি আমদানি বিল।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকার এক জ্বালানি বিশ্লেষক বলেন, “ভারত-চীন নিজেদের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজে পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের হাতে সে সুযোগ নেই। তারা বাজারে যা আছে তাই কিনতে বাধ্য।”
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (IEA)-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী এক বছরে এশীয় অঞ্চলের তেলের চাহিদা ৪ শতাংশ বাড়বে। এতে বৈশ্বিক বাজারে চাপ অব্যাহত থাকবে।
সম্ভাব্য সমাধান
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল অর্থনীতিগুলোর সামনে কয়েকটি পথ খোলা আছে—
- • দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি করা
- • নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো
- • আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে তেল ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া
- • বৈদেশিক মুদ্রার সংরক্ষণে অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমানো
এশিয়ার বড় দেশগুলো তেল কেনা বাড়াতে থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকবে। এর সরাসরি আঘাত পড়বে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোতে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও আফগানিস্তান একদিকে ডলার সংকটে জর্জরিত, অন্যদিকে বাড়তি আমদানি ব্যয়ে দিশেহারা। এই পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
তেলের এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা তাই দক্ষিণ এশিয়ার ছোট অর্থনীতির জন্য এক অদৃশ্য ঝড়, যার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।