(সম্প্রতি প্রখ্যাত সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর মর্মান্তিক প্রয়াণ স্মরণে। )
আমৃত্যু সত্যের জন্য যে-নির্ভীক কলম সেবক
নিরপেক্ষ অক্ষরের অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন
দুর্জনের প্রতারণা ঠকবাজের ধুরন্ধর চাল
সুবেশী মুখোশধারী গুপ্তচোরা শত্রুর ভ্রুকুটি,
সোনার মোহর আর নানাবিধ রঙিন ইশারা
সবকিছু তুচ্ছ জ্ঞানে স্বনামেই সতত যে-তিনি
একান্ত বিরল এক আলোকিত সুজন মানুষ;
মোহের উজান টানে, সঙ্গীদের নানা প্রলোভনে
কখনো দেখেনি কেউ কোনোমতে তাকে যুক্ত হতে;
বিলাসী জীবন ছকে নিরাপদ সংসার সাজাতে
কখনো লোভের ফাঁদে কিংবা কোনো দূষিত ডেরায়
গোপন নেশার ডাকে কোনোদিন পড়েনি পা তার ;
দুর্বিনীত দুঃসময়ে জর্জরিত বিপন্ন সুন্দর
যখন মৌলিক প্রশ্নে জনতার মানবাধিকার
উন্মাদের কোপানলে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে,
সে-সময় তাকে দেখি ভূলুণ্ঠিত মনীষার পাশে
অলৌকিক মহিমার লাঠি হাতে সাহসে দাঁড়াতে।
দুরাচারী কৌরবেয় বন্দুকের নলের ডগায়
কী নির্ভয়ে সামনে এসে দৃঢ় চিত্তে অবিচল থেকে
আশা ও বিশ্বাস বুকে কাউকেই না- করে পরোয়া
মিথ্যার বিরুদ্ধে তিনি অবিরাম লড়াকু পাণ্ডব।
তার যে-কলম ছিলো অর্জুনের লক্ষভেদী তীর
সে- কলমে পৌরুষেয় দীপ্তি আনে পরম সততা ;
নিয়তি এমন লিপি কেন লেখে তোমার কপালে–
স্বভাব বিরুদ্ধ পথে তুমি গেলে কাপুরুষ হতে!
মর্মান্তিক এই সত্য আমি কিন্তু মানতে রাজি নই;
সমূহ মহতী গুণ আর আত্মমুখী স্বভাব দোষেই
কেন যে নিষ্প্রাণ তুমি ভাসতে গেলে মেঘনার জলে!
২.
এমন অভাগা দেশে জন্ম যার যাপিতজীবনে
বিপরীত ভ্রষ্টাচারী দুর্দিনের আগ্রাসী থাবায়
নীরবে নিঃশেষ হয়ে নিভে গেল আলোর সারথি !
সত্য কথা বললে যদি মরতে হয়, তবে মরে যাবে
এমন দৃঢ়তা নিয়ে প্রতিবাদে আত্মবিসর্জন
বাঙালির বীর বিভু ছাড়া আর কেবা দিতে পারে!
তোমার বিশুদ্ধ মনে নিত্য যারা
মিথ্যাজাল পাতে
তারা কিন্তু প্রত্যেকেই স্বঘোষিত খুনি প্রতারক;
তোমার মৃত্যুর কাছে যদি সত্য
পরাজিত হয়,
তবে কেন ভাই মিথ্যার বিপক্ষে লড়ে মৃত্যুকেই
অবশেষে জীবনের উল্টোদিকে
শ্রেয় ভেবেছিলে?
কী করে বিভু দা তুমি এমন করুণ নদীজলে
নির্লজ্জ অসৎ কানা মৃত প্রায় নষ্ট বিবেকের
খিলআটা দরোজায় লাথি মারতে মারতে চলে গেলে!
৩.
এটাই প্রকৃত সত্য: জলে স্থলে অন্তরীক্ষ্যে আজ
যারা অন্ধ ব্যভিচারী তারা নাকি চোখে দেখে বেশি;
যেখানে উলঙ্গ রাজা দাসী নিয়ে গলাগলি খায়,
বিয়ের আসরে যায় আজকাল নপুংসক খোজা
সেখানে এমনভাবে আর কতো কষ্টের বয়ান
হিজড়া-কানা- বোবা মিডিয়ার পাতা জুড়ে লেখা হবে
এক খোলা চিঠি ; অতঃপর নিখোঁজ সংবাদ শেষে
নদীতে তোমার দেহ প্রাণহীন লাশ হয়ে ভাসে:
যথারীতি সে-লাশ উদ্ধার করে আইনের বাবুরা
মনে মনে বলে, কী দরকার ছিল বাপু! মরণের
যদি সাধ হয়েছিল তবে কেন এতো দূরে এলে!
বাসা কিংবা বাসার কাছেই কত পথ খোলা ছিল!
গঙ্গা ভেবে মেঘনার নোংরা জলে
ডুবে গিয়ে মরা!
আমাদের কতো কাজ! কুমানুষ চোর- ডাকাতের
হাত থেকে মানুষের জানমাল ইজ্জত ছাড়াও
আরও অনেক কিছু রক্ষা করতে হয়; কীকুক্ষণে
সব কাজ ফেলে রেখে অবাঞ্ছিত এই লাশ নিয়ে
নিরুপায় কী যে এক বড্ড ঝামেলায় পড়ে গেছি !
কী করে বিশ্বাস করি : আতঙ্কিত এই পোড়া মন
কিছুতেই প্রবোধ মানে না, তবু আজ লিখতে হচ্ছে
যার কলমের এতো তেজ তাকে কেন মরতে হলো
অভিমানে হতাশায়? দায় কার– কেউ কি নেবে না?
এ দায় কেবল তার যার আছে অলীক ক্ষমতা।
৪.
এক নামে দেশ জুড়ে খ্যাতি যার খ্যাতিমান তিনি–
এমন প্রবীণ আর জনপ্রিয় সাংবাদিকের লাশটাকে নদী থেকে তুলে এনে ভ্যানে রাখা হলো;
দৃশ্যটা কেমন, দেখি : ভ্যানে করে লাশ যাচ্ছে মর্গে,
দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে গেছে, লাশের ওপরে
ভনভন করে কতো মাছি উড়ছে ; খুব ভারী লাশ;
ভ্যানটা চালাচ্ছে এক হাড্ডিসার ম্রিয়মাণ বুড়ো;
ক্লান্ত পথ চলতে চলতে কেন জানি তার মনে হলো
একটা লাশের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বহু লাশ–
পচাগলা অগুনিত লক্ষ লক্ষ লাশ;প্রশ্ন জাগে
নিরক্ষর ভ্যান চালকের মনে– একটা মানুষ
বহুকাল ধরে এতো এতো লাশ কী করে নিজের বুকে
যত্ন করে রাখে? এসব লাশের কী বা আছে পরিচয় —
নাম-গোত্র-পেশাহীন এদের ঠিকানা নেই আজ!
মৃতদের কোনো জাত ধর্ম নেই; তবু কেন জানি
তার মনে হলো, আরে এটা তো এখন আর কারো লাশ নয় —
এটা তো আমার বা আমাদের অমৃতের লাশ!
তারপর পৃথিবীকে প্রচণ্ড ধিক্কার দিতে দিতে
ভ্যান চালকের প্রতি বিনম্র প্রণতি জানিয়ে লাশটা
আস্তে করে ঢুকে যায় অতি পুরাতন লাশকাটা ঘরেঃ
দু’জন মেধাবী ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী আছে তার;
মেয়েটা ডাক্তার, আর ছেলে বুয়েটের প্রকৌশলী–
এমন সফল পিতা লাশ হয়ে মর্গে শুয়ে আছে!
৫.
জন্মের পোশাকে মর্গে আছে লাশ : নাকে- মুখে
সুগন্ধি রুমাল বেঁধে অনিচ্ছুক সডোম ডাক্তার
মশা ও মাছির রাজ্যে কর্তব্যের ডাক পেয়ে ঢুকে ;
সুদক্ষ ডোমের হাতযশ নাম ডাক বেশ ভালো;
ময়নাতদন্ত হচ্ছে ; ডাক্তার সাহেব খুঁজতে থাকে
মৃত্যুর কারণ; মরদেহ ছুরি দিয়ে তাড়াতাড়ি
কাটাছেঁড়া করে ; লাশটাকে কাটতে গিয়ে এটা – ওটা কাটে–
এটা কাটে, ওটা কাটে; কাটতে কাটতে এটা দেখে, ওটা দেখে
দেখে দেখে মৃত্যুর রহস্য খোঁজে অনেক গভীরে:
অবশেষে হৃৎপিণ্ড কাটতে গিয়ে ওরা দু’জনেই
আচানক চমকে ওঠে, ডাক্তার বলেন, আরে আরে
এ কী দেখছি, কী করে সম্ভব হলো এটা– স্বপ্ন নয় তো!
মৃত সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার মৃত্যুর পরও
তার হৃৎপিণ্ডে ধরে আছে রক্তমাখা বাংলাদেশ।
আসাদ মান্নান 



















