৭. জল আচরণীয় হিন্দু অথচ নবশাখ নহে জল আচরণীয় হিন্দুর মধ্যে কতকগুলি
জাতি আছে যাহাদের জল এ জেলায় প্রচলিত আছে অথচ তাহারা নবশাখ নহে, যথা-১. কৈবর্ত, ২. দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী গোপ (গোয়ালা)। কৈবর্ত জাতির উল্লেখ বাল্মীকি প্রণীত রামায়ণে দেখা যায়। রাম বনবাস সময়ে কৈবর্তরাই তাহাকে গঙ্গানদী পার করিয়াছিল। এটি পুরাতন জাতি। ‘কৈবর্তে দাস দাস-ধীবরেী’, এরূপ কৈবর্ত রাজসাহীতে নাই। কৈবর্তগণ দুই ভাগে বিভক্ত যথা-১. হেলে কৈবর্ত ২. জেলে কৈবর্ত। যাহারা কৃষি কর্ম ও দাসবৃত্তি করে, তাহারা হেলে কৈবর্ত। যাহারা মৎস্য ধরে এবং নাবিকের কার্য করে, তাহারা জেলে কৈবর্ত। রাজসাহীতে দ্বিতীয় শ্রেণির কৈবর্ত নাই। এই জেলায় হেলে কৈবর্তই সমুদয়। ইহারা জল আচরণীয় কিন্তু ইহাদের পুরোহিতের জল ব্যবহার নাই। দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী গোপ (গোয়ালাদের) এবং তাহাদের পুরোহিতের জল প্রচলিত আছে। এই দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী গোপ দুই ভাগে বিভক্ত যথা-একভাগ দুগ্ধ মন্থন করিয়া মাখন প্রস্তুত করে। ইহাদের কাড়িয়া গোয়ালা বলে এবং ইহারা কৃষিকর্মও করে। অপরভাগ দধি মন্থন করিয়া মাখন প্রস্তুত করে। ইহাদের বারেন্দ্র বা বাথানীয়া গোপ বলে। ইহারা পূর্বে একটি বিস্তৃত মাঠে বহুসংখ্যক গাভি রাখিয়া দধি দুগ্ধের ব্যবসা করিত। কৃষি কার্যের উন্নতিতে গাভী পোষণের জন্য মাঠ আর পাওয়া যায় না। যে মাঠে গাভীগণ থাকিত, তাহাকে বাথান বলিত। এক্ষণ রাজসাহীতে আর বাথান নাই। এক্ষণ গ্রাম গ্রাম হইতে দুগ্ধ ক্রয় করিয়া ব্যবসা করে।
কৈবর্তের সংখ্যই বেশি। কৈবর্ত প্রায় ৬০,০০০ কি ৭০,০০০; গোয়ালা প্রায় ৯০০০ কি ১০,০০০ হইবে। কৈবর্ত প্রায়ই কৃষক। গোয়ালা ও কৈবর্তের অবস্থা সাধারণত মন্দ নহে। রাজসাহীর উত্তর ও দক্ষিণ ভাগেই কৈবর্তের সংখ্যা বেশি। পদ্মানদীর তীবরর্তী বেঙ্গগাড়ি গ্রামে যে সকল কৈবর্ত আছে; তন্মধ্যে ভৌমিক বংশীয়েরা শিক্ষিত। ইহারা জমিদার ও বাণিজ্য ব্যবসায়ী।
৮। জল অনাচরণীয় হিন্দু এই প্রকার হিন্দুর মধ্যে নানা শ্রেণি। রজক, হেলে’ রজক, তাঁতি, যোগী, গুঁড়ি বা সাহা, ছুতার, চণ্ডাল, জালিয়া, হকার প্রভৃতি অনাচরণীয় হিন্দুর বাস। হেলে রজক ও সাহা জাতির মধ্যে কতকগুলি ধনী মহাজন ও জমিদার আছে। ইহাদের সংখ্যা অতি কম। পুরাণ শাস্ত্র প্রণয়নের সময় হইতে হিন্দু সমাজ হীন অবস্থায় পতিত। এসময় হইতে এদেশীয় অসভ্য জাতিদের আর্যগণ বিবাহাদি করিতে লাগিলেন বা দ্বিজাতীরা অসবর্ণা ভাষা গ্রহণ করিতে লাগিলেন। ইহাতে হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল, যুগী, হেলে রজক প্রভৃতি নিচ জাতি সকলের উৎপত্তি হইল। ইহারাই সঙ্কর জাতি বলিয়া একটি সাধারণ নাম ধারণ করিল। রাজসাহীতে সঙ্কর জাতি নিতান্ত কম নহে।
রাজসাহীতে বৈষ্ণবের সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার বা ১৫ হাজার হইবে। ইহারা কোন জাতির অন্তর্গত নহে। মহাত্মা চৈতন্যদেবের সময় হইতে এই জাতির উৎপন্ন হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে ভেদাভেদ নাই। অধুনা অধিকাংশই ভিক্ষা ব্যবসায়ী। কেহ কেহ অন্য ব্যবসা করে এবং লেখাপড়া শিক্ষা করিয়া চাকরিও করিয়া থাকে।
মুসলমান-রাজসাহী জেলার মোট লোক সংখ্যার তিন ভাগের অধিক মুসলমান, প্রায় এক ভাগ হিন্দু। রাজসাহীর মুসলমান সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। এক শ্রেণির মুসলমান কোরাণের প্রকৃত ধর্ম প্রতিপালন করিয়া থাকে। অপর শ্রেণি মুসলমান উভয় হিন্দু ও মুসলমান দেবতাকে কোন কোন স্থানে সমানভাবে ভক্তি করে। প্রথম শ্রেণি মুসলমানের সংখ্যা অতি কম। ইহাদের মধ্যে অনেকেই সুশিক্ষিত। দ্বিতীয় শ্রেণি মুসলমানের
রীতিনীতি ও ধর্মপ্রণালী কোন কোন অংশে ইতর হিন্দুর ন্যায়। ইহাতে বিশ্বাস করা যাইতে পারে যে, ইহারা পূর্বে ইতর হিন্দু ছিল। মুসলমান রাজত্ব সময় ইহারা মুসলমান হয়। ইহারা প্রায়ই অশিক্ষিত। আজি কালি এই দ্বিতীয় শ্রেণির মুসলমান মধ্যেও শিক্ষা বিস্তার আরম্ভহইয়াছে। মুসলমান মধ্যে যদিচ জাতিভেদ নাই, তথাপি দ্বিতীয় শ্রেণির মুসলমানদিগকে ৫ শ্রেণিতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। যথা-
১. কৃষক-এই শ্রেণি মুসলমানের মধ্যে অনেকে ভদ্রবংশীয়। ইহাদের ব্যবসা অতি পবিত্র। রাজসাহীর কয়কদের অবস্থা নিতান্ত মন্দ নহে। ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ কোরাণের প্রকৃত ধর্ম আচরণ করে। আজকাল কৃষক সন্তানেরাও সুশিক্ষিত হইতেছে।
২. বার মাসিয়া-ইহাদের নির্দিষ্ট বাসস্থান নাই। প্রায় নৌকাই ইহাদের বাসস্থান। সূচ, সুতা, চিরণী, আয়না ইত্যাদি দ্রব্য লইয়া হাটে ও গ্রামে গ্রামে বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।
৩. জোলা-ইহারা মোটা কার্পাস বস্ত্র এবং মোটা মশারি প্রস্তুত করে। ইহাদের সংখ্যা নিতান্ত কম।
৪. নলুয়া- ইহারা নলের দড়মা প্রস্তুত করে এবং কেহ কেহ সময় সময় কৃষিকার্যও করে।
৫. চুলি ও বেহারা-রাজসাহী জেলার দক্ষিণভাগে কতকগুলি মুসলমান আছে। তাহারা বিবাহ আদিতে ঢোল বাজায় এবং পালকি আদি বহন করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।
বার মাসিয়া, জোলা, নলুয়া, চুলি ও বেহারা এই প্রকার নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের সহিত প্রথম শ্রেণির বা কৃষকশ্রেণি ভদ্রবংশজাত মুসলমানদের বিবাহ বা আহারাদি প্রচলিত নাই। এই সকল নিম্ন মুসলমানের ব্যবহার ও ব্যবসা কোন কোন অংশে ইতর হিন্দুর সমান। মুসলমান রাজত্বকালে কতকগুলি ইতর হিন্দু মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়। নিম্ন শ্রেণি ও অনেক কৃষক মুসলমানদের আচার, নীতি ও ধর্মপ্রণালী দেখিয়া ইহা সম্পূর্ণ সম্ভব যে নিম্ন শ্রেণি ও কতকগুলি কৃষক শ্রেণির মুসলমানেরা ইতর হিন্দুর বংশধর হইবে। ইহাদের মধ্যে অনেকে ইতর হিন্দুদের আচার ব্যবহার ও ধর্মপ্রণালী ত্যাগ করিয়া প্রকৃত মুসলমানের আচার ব্যবহার গ্রহণ করিতেছে।
মুসলমান অধিকাংশই কৃষক। নাটোর, বাগা, বাঘধনী, তারাটিয়া প্রভৃতি স্থানে কতিপয় মুসলমান জমিদার আছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















