ইউরোপের রাসায়নিক শিল্পে নতুন সংকট
যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্ক বিশ্ব বাণিজ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে ইউরোপের রাসায়নিক খাত আবারও ধাক্কা খাচ্ছে। গ্রাহকরা অর্ডার দিতে দেরি করছে, যার কারণে ২০২২ সালের জ্বালানি সংকট থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা ভেঙে পড়ছে।
চাপে ইউরোপের বড় রপ্তানি খাত
ইউরোপীয় ইউনিয়নের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি খাত হলো রাসায়নিক শিল্প, যা যন্ত্রপাতি, গাড়ি ও ওষুধ শিল্পের পরেই অবস্থান করছে। তবে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য আকাশছোঁয়া হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় কিছু প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই কারখানা বন্ধ ও কর্মী ছাঁটাই করেছে।
২০২৩ সালে বিশ্ব রাসায়নিক বিক্রয়ের ১২.৬ শতাংশ, অর্থাৎ ৬৫৫ বিলিয়ন ইউরো এসেছে ইউরোপ থেকে। এটি গত দশ বছরে প্রায় ৪ শতাংশ হ্রাস নির্দেশ করে।
ট্রাম্পের শুল্কের আঘাত
যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর অন্তত ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এতে গাড়ি, যন্ত্রপাতি ও ভোক্তা পণ্য খাতসহ রাসায়নিক শিল্পের বড় গ্রাহকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ব গাড়ি নির্মাতারা ইতিমধ্যে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়েছে।
এলএসইজি (LSEG)-এর তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় রাসায়নিক কোম্পানির তৃতীয় প্রান্তিকের আয় ৫ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই পতন ছিল ২২ শতাংশ।
প্রতিযোগিতা ও মুনাফার চাপ
মেটজলার রিসার্চের বিশ্লেষক টমাস শুল্টে-ফোরভিক বলেন, শুল্ক, এশীয় প্রতিযোগিতা ও দাম কমার চাপ একসাথে এখন একটি “বিষাক্ত পরিস্থিতি” তৈরি করেছে।
বিএএসএফ (BASF), ব্রেনট্যাগ (Brenntag) এবং ল্যানক্সেস (Lanxess)-এর মতো বড় কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী উপস্থিতির কারণে সরাসরি শুল্কের আঘাত থেকে আংশিক সুরক্ষিত থাকলেও সতর্ক গ্রাহক আচরণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গ্রাহকেরা এখন মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই অর্ডার দিচ্ছে, যেখানে আগে তিন থেকে চার মাস আগে অর্ডার দেওয়া হতো।
সস্তা চীনা পণ্যের ঝুঁকি
ব্রেনট্যাগের প্রধান নির্বাহী ক্রিশ্চিয়ান কোলপেইন্টনার সতর্ক করেছেন যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ১০ নভেম্বরের আগে সমঝোতা না হয়, তবে চীনা রাসায়নিক পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে ইউরোপে ঢুকে পড়তে পারে। এতে ইউরোপীয় বাজার আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দুর্বল ডলার ও মুনাফা সংকট
ডলারের দুর্বলতা ইউরোপীয় কোম্পানির জন্য নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব কোম্পানি ইউরোয় লাভ হিসাব করে, তাদের ক্ষতি হচ্ছে।
ডাচ কোম্পানি আকজো নোবেল (Akzo Nobel) জুলাই মাসে ২০২৫ সালের মুনাফার পূর্বাভাস কমিয়েছে। জার্মানির ভ্যাকার কেমি (Wacker Chemie) একই মাসে তাদের পূর্বাভাস সংশোধন করে কারণ দুর্বল ডলার ও পণ্যের কম চাহিদা তাদের আঘাত করেছে।
ভবিষ্যতের আশা ও শঙ্কা
কেপলার চ্যুভরক্সের ক্রিশ্চিয়ান ফেইটজ বলেন, ইউরোপের রাসায়নিক শিল্প ধারাবাহিকভাবে মন্থর হচ্ছে, তবে ২০২৬ সালের দিকে চাহিদা স্থিতিশীল হতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ইউরোর রাসায়নিক রপ্তানি করেছে, যা ২০২৩ সালের ৩৮ বিলিয়ন ইউরোর চেয়ে সামান্য বেশি। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন ইউরো।
ইউরোপের স্থানীয় রাসায়নিক শিল্পের এক-তৃতীয়াংশ বিক্রি হয় বিদেশে, যেখানে চীন সবচেয়ে বড় বাজার।
বড় ও ছোট কোম্পানির ভিন্ন চিত্র
ল্যানক্সেসের প্রধান নির্বাহী মাতিয়াস জ্যাকার্ট সতর্কতার মাঝেও আশা করছেন, বছরের শেষ দিকে বাজার স্থিতিশীল হতে পারে। তবে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ছে।
হামবুর্গভিত্তিক পরিবার-স্বত্বাধিকারী কোম্পানি হোবুম ওলিওকেমিক্যালস্ (Hobum Oleochemicals) একটি বড় মার্কিন গ্রাহক হারিয়েছে, যা তাদের বিক্রয় বহুগুণ বাড়াতে পারত। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আর্নল্ড মার্গেল বলেন, “এখন আর কোনো নির্ভরযোগ্যতা নেই। এটি প্রকল্প ও বিনিয়োগের জন্য ভয়াবহ বিষের মতো কাজ করছে।”