নতুন সিনথেটিক ড্রাগে বিপর্যস্ত আফ্রিকার তরুণরা
নায়েমার গল্প
ফ্রিটাউনের এক তরুণী নায়েমা (২৫) সহায়তা কেন্দ্রের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লেন। তার ভয় ছিল, সামনে দিয়ে গেলে ব্যাগ তল্লাশি করা হতে পারে। তিনি প্রথমে এই কেন্দ্রে এসেছিলেন এইচআইভি প্রতিরোধক ওষুধ (প্রি-এক্সপোজার প্রফাইল্যাক্সিস) নিতে। কিন্তু এবার এসেছেন অন্য কারণে—কুশ নামের এক শক্তিশালী সিনথেটিক মাদক থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে।
নায়েমা একা নন। সিয়েরা লিওনসহ পশ্চিম আফ্রিকার বহু তরুণ-তরুণী কুশের আসক্তিতে ভুগছেন। সস্তা ও ভয়াবহ আসক্তিকর এই সিনথেটিক ওপিওয়েড অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই মাদক নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। কর্মসংস্থানের সংকট ও দারিদ্র্যের কারণে তরুণরা সহজেই এই ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে।

কোকেন থেকে ট্রামাডল, তারপর কুশ
পশ্চিম আফ্রিকা আগে থেকেই আন্তর্জাতিক মাদকপথে পরিচিত। কোকেন ও হেরোইনের পর ২০১০-এর দশকে ট্রামাডল নামে এক ব্যথানাশক সড়কে জনপ্রিয় হয়। ভারত থেকে আসা এই ওষুধ মূলত নাইজেরিয়া হয়ে পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ২০১৮ সালে ভারতের আইন পরিবর্তনে এটি দামী হয়ে যায়। তখন ফাঁক পূরণ করে কুশ, যা আরও সস্তা ও বিপজ্জনক। একটি ডোজ মাত্র ৪০ সেন্ট।
ভয়ংকর রাসায়নিক সংমিশ্রণ
আন্তর্জাতিক অপরাধ পর্যবেক্ষক সংস্থা (GI-TOC) এর পরীক্ষায় দেখা গেছে, কুশে প্রায়ই নাইটাজিন নামের নতুন ধরনের ওপিওয়েড থাকে। এটি ফেন্টানিলের চেয়ে ২৫ গুণ শক্তিশালী। আর ফেন্টানিল নিজেই হেরোইনের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী। ফলে অল্প পরিমাণেই ভয়াবহ প্রভাব তৈরি হয়।

মাদক তৈরির কাঁচামাল সহজেই চীন, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস থেকে কুরিয়ার সার্ভিসে আনা হয়, যেগুলো মেশিন তেল বা “ফ্লেভার স্প্রে” হিসেবে ছদ্মবেশে পাঠানো হয়। এগুলো অ্যাসিটনে মিশিয়ে মার্শমেলো পাতায় ছিটিয়ে দেওয়া হয়, শুকিয়ে গুঁড়া বানিয়ে ধূমপানের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ব্যবহারকারীরা আসলে কী খাচ্ছেন তা জানেন না, ফলে অতিরিক্ত সেবনের ঝুঁকি আরও বাড়ে।
জীবনের ক্ষয়ক্ষতি
কুশের কারণে অসংখ্য তরুণ পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে। ফ্রিটাউনের মানসিক হাসপাতালের অধ্যাপক ড. জর্জ ইজে বলছেন, বেশিরভাগ কুশ-আসক্ত তরুণদের কিছুটা শিক্ষাগত পটভূমি থাকে। নায়েমা নিজেও বলেন, “ঘুম, মাথা ঘোরা—এসবের মধ্যে ডুবে গেলে ভবিষ্যৎটা ঘুমিয়েই কাটবে।”
এই মাদক থেকে আত্মক্ষতি ও মানসিক রোগ দেখা দিচ্ছে। এক রোগী টেলিভিশনে নিজের বান্ধবীকে দেখার ভ্রমে হাত কেটে ফেলেছিলেন। ক্ষুধামন্দার কারণে অপুষ্টি হয়, যা অন্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। অনেক নারী আসক্তি মেটাতে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন, ফলে যৌন রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
ডাচ থিঙ্কট্যাঙ্ক ক্লিঙ্গেনডেল ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, শুধু পশ্চিম আফ্রিকাতেই হাজারো মৃত্যু ঘটেছে কুশের কারণে। সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউনে প্রায় সবাই অন্তত একজন আসক্তকে চেনে। এমনকি মেয়রকে মৃতদেহ সংগ্রহের জন্য বিশেষ দল গঠন করতে হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে গণকবর ও দাহ কার্যক্রম চলছে।
সরকারের প্রচেষ্টা ও সীমাবদ্ধতা
২০২৪ সালের শুরুর দিকে সিয়েরা লিওন ও লাইবেরিয়া কুশকে ঘিরে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট বহুমন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন। তাদের কাজ—আসক্তদের শনাক্ত করা, পুনর্বাসন কেন্দ্রে নেওয়া, চিকিৎসা করানো ও সমাজে ফিরিয়ে দেওয়া।
কুশের ক্ষতি সম্পর্কে প্রচারণা বাড়ানো হয়েছে। কর্মকর্তাদের দাবি, মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে। তবে স্বীকার করা হচ্ছে, ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোটেই কমছে না।

বৈশ্বিক সমাধানের প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট নিয়ন্ত্রণ করতে শুধু স্থানীয় উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। চীন থেকে রপ্তানি ও ইউরোপে সিনথেটিক ওপিওয়েড নিয়ন্ত্রণ কঠোর করতে হবে। পাশাপাশি সরকারগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক সরঞ্জামও দরকার। কিন্তু এসব উদ্যোগ এখনো সীমিত।
ফলে আফ্রিকার দেশগুলো আপাতত খণ্ডিত প্রচেষ্টায় আসক্তদের কিছুটা সাহায্য করছে। কিন্তু প্রত্যাহার প্রক্রিয়া খুবই কঠিন এবং কখনও প্রাণঘাতীও হতে পারে।
নায়েমা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমি শেষবার কুশ খেয়েছি গতকাল। এটা আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে…তবুও আমি কমাচ্ছি, চেষ্টা করছি।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















