০৯:৫৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫

বিশ্বের অন্যতম পবিত্র স্থান সিনাই পর্বতকে মেগা-রিসোর্টে রূপান্তর করা হচ্ছে

পবিত্র ভূমির রূপান্তর

মিশরের সিনাই উপদ্বীপে অবস্থিত জাবাল মুসা বা মাউন্ট সিনাই দীর্ঘদিন ধরে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের কাছে সমানভাবে পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। ধারণা করা হয়, এখানেই নবী মুসা আল্লাহর কাছ থেকে দশটি আজ্ঞা পেয়েছিলেন এবং বাইবেল ও কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী জ্বলন্ত ঝোপ থেকে ঈশ্বর তার সঙ্গে কথা বলেন।

৬ষ্ঠ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার নিয়ন্ত্রিত সেন্ট ক্যাথরিন মঠটি বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সক্রিয় খ্রিস্টীয় মঠ। তবে বর্তমানে এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল পর্যটন প্রকল্প শুরু হয়েছে, যা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা

মিশর সরকার “গ্রেট ট্রান্সফিগারেশন প্রজেক্ট” নামে ২০২১ সালে একটি বৃহৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা শুরু করেছে। এর আওতায় হোটেল, ভিলা, শপিং সেন্টার, দর্শনার্থী কেন্দ্র, এমনকি মাউন্ট মুসায় পৌঁছানোর জন্য ক্যাবল কার তৈরি করা হচ্ছে। নিকটবর্তী বিমানবন্দরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনায় রয়েছে। সরকার একে বিশ্বের সব ধর্মের জন্য “মিশরের উপহার” হিসেবে বর্ণনা করছে।

কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, প্রকল্পটি পর্যটন বাড়াবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং এলাকার সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করবে। তবে সমালোচকদের মতে, এটি স্থানীয় প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে।

বেদুইনদের ওপর প্রভাব

এ অঞ্চল বহু শতাব্দী ধরে জেবেলিয়া নামের বেদুইন উপজাতির বাসস্থান। তারা সেন্ট ক্যাথরিন মঠের “অভিভাবক” নামে পরিচিত। কিন্তু প্রকল্পের কারণে তাদের বাড়িঘর ও ইকো-ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি স্থানীয় কবরস্থান সরিয়ে পার্কিং জায়গা তৈরি করা হচ্ছে। অনেকেই ক্ষতিপূরণ পাননি।

ব্রিটিশ ভ্রমণলেখক বেন হফলার বলেন, “এটি বেদুইনদের চাওয়া কোনো উন্নয়ন নয়, বরং বাইরের স্বার্থে চাপিয়ে দেওয়া একরকম শহরায়ন। এর ফলে তারা নিজেদের ভূমি ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।”

গ্রিস ও মিশরের টানাপোড়েন

গ্রিস সেন্ট ক্যাথরিন মঠের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত। এ বছরের মে মাসে মিশরের একটি আদালত রায় দেয় যে মঠটি রাষ্ট্রীয় জমির ওপর নির্মিত এবং শুধু ব্যবহারের অধিকার আছে।

এ রায়কে “অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম ও হেলেনিজমের ওপর হুমকি” বলে মন্তব্য করেন গ্রীসের আর্চবিশপ ইয়েরোনিমস। মঠের প্রধান আর্চবিশপ দামিয়ানস এ সিদ্ধান্তকে “গুরুতর আঘাত” হিসেবে উল্লেখ করেন।

পরবর্তীতে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে গ্রিস ও মিশর যৌথভাবে মঠের গ্রিক অর্থোডক্স পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইউনেস্কো ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

১৯৮০ সাল থেকে এ অঞ্চল ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ইউনেস্কো বলছে, “অকৃত্রিম প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিক প্রতিশ্রুতির এক অনন্য মেলবন্ধন এখানে প্রতিফলিত হয়েছে।”

তবে ২০২৩ সালে সংস্থাটি মিশরকে উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে প্রভাব যাচাই ও সংরক্ষণ পরিকল্পনা করার আহ্বান জানায়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ওয়াচ দাবি করেছে, এলাকা যেন বিপদাপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এমনকি সেন্ট ক্যাথরিন ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ব্রিটেনের রাজা চার্লসের কাছেও আবেদন জানানো হয়েছে।

অর্থনীতি বনাম ঐতিহ্য

মিশর সরকার বলছে, অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে এবং ২০২৮ সালের মধ্যে ৩ কোটি পর্যটক আকর্ষণ করতে এ ধরনের মেগা-প্রকল্প জরুরি।

কিন্তু ইতিহাস বলছে, সিনাই অঞ্চলের বেদুইনরা বরাবরই উন্নয়ন প্রকল্পে উপেক্ষিত। ১৯৮০-এর দশকে শারম এল-শেখসহ লাল সাগরের রিসোর্টগুলো নির্মাণের সময়ও স্থানীয়দের ব্যবসা ও ভূমি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাংবাদিক মোহান্নাদ সাবরি মনে করেন, এবারও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

সেন্ট ক্যাথরিন মঠ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নানা রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও টিকে আছে। তবে এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিশাল রিসোর্ট প্রকল্পের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বেদুইনদের জীবনধারা এবং এলাকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্থায়ীভাবে বদলে যাবে।

যদিও মঠ ও এর আধ্যাত্মিক মর্যাদা অটুট থাকবে, তবে এর আশপাশের পরিবেশ ও শতাব্দী-প্রাচীন জীবনযাত্রা হয়তো আর আগের মতো থাকবে না।

জনপ্রিয় সংবাদ

বিশ্বের অন্যতম পবিত্র স্থান সিনাই পর্বতকে মেগা-রিসোর্টে রূপান্তর করা হচ্ছে

০১:০০:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পবিত্র ভূমির রূপান্তর

মিশরের সিনাই উপদ্বীপে অবস্থিত জাবাল মুসা বা মাউন্ট সিনাই দীর্ঘদিন ধরে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের কাছে সমানভাবে পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। ধারণা করা হয়, এখানেই নবী মুসা আল্লাহর কাছ থেকে দশটি আজ্ঞা পেয়েছিলেন এবং বাইবেল ও কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী জ্বলন্ত ঝোপ থেকে ঈশ্বর তার সঙ্গে কথা বলেন।

৬ষ্ঠ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার নিয়ন্ত্রিত সেন্ট ক্যাথরিন মঠটি বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সক্রিয় খ্রিস্টীয় মঠ। তবে বর্তমানে এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল পর্যটন প্রকল্প শুরু হয়েছে, যা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা

মিশর সরকার “গ্রেট ট্রান্সফিগারেশন প্রজেক্ট” নামে ২০২১ সালে একটি বৃহৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা শুরু করেছে। এর আওতায় হোটেল, ভিলা, শপিং সেন্টার, দর্শনার্থী কেন্দ্র, এমনকি মাউন্ট মুসায় পৌঁছানোর জন্য ক্যাবল কার তৈরি করা হচ্ছে। নিকটবর্তী বিমানবন্দরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনায় রয়েছে। সরকার একে বিশ্বের সব ধর্মের জন্য “মিশরের উপহার” হিসেবে বর্ণনা করছে।

কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, প্রকল্পটি পর্যটন বাড়াবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং এলাকার সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করবে। তবে সমালোচকদের মতে, এটি স্থানীয় প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে।

বেদুইনদের ওপর প্রভাব

এ অঞ্চল বহু শতাব্দী ধরে জেবেলিয়া নামের বেদুইন উপজাতির বাসস্থান। তারা সেন্ট ক্যাথরিন মঠের “অভিভাবক” নামে পরিচিত। কিন্তু প্রকল্পের কারণে তাদের বাড়িঘর ও ইকো-ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি স্থানীয় কবরস্থান সরিয়ে পার্কিং জায়গা তৈরি করা হচ্ছে। অনেকেই ক্ষতিপূরণ পাননি।

ব্রিটিশ ভ্রমণলেখক বেন হফলার বলেন, “এটি বেদুইনদের চাওয়া কোনো উন্নয়ন নয়, বরং বাইরের স্বার্থে চাপিয়ে দেওয়া একরকম শহরায়ন। এর ফলে তারা নিজেদের ভূমি ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।”

গ্রিস ও মিশরের টানাপোড়েন

গ্রিস সেন্ট ক্যাথরিন মঠের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত। এ বছরের মে মাসে মিশরের একটি আদালত রায় দেয় যে মঠটি রাষ্ট্রীয় জমির ওপর নির্মিত এবং শুধু ব্যবহারের অধিকার আছে।

এ রায়কে “অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম ও হেলেনিজমের ওপর হুমকি” বলে মন্তব্য করেন গ্রীসের আর্চবিশপ ইয়েরোনিমস। মঠের প্রধান আর্চবিশপ দামিয়ানস এ সিদ্ধান্তকে “গুরুতর আঘাত” হিসেবে উল্লেখ করেন।

পরবর্তীতে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে গ্রিস ও মিশর যৌথভাবে মঠের গ্রিক অর্থোডক্স পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইউনেস্কো ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

১৯৮০ সাল থেকে এ অঞ্চল ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ইউনেস্কো বলছে, “অকৃত্রিম প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিক প্রতিশ্রুতির এক অনন্য মেলবন্ধন এখানে প্রতিফলিত হয়েছে।”

তবে ২০২৩ সালে সংস্থাটি মিশরকে উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে প্রভাব যাচাই ও সংরক্ষণ পরিকল্পনা করার আহ্বান জানায়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ওয়াচ দাবি করেছে, এলাকা যেন বিপদাপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এমনকি সেন্ট ক্যাথরিন ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ব্রিটেনের রাজা চার্লসের কাছেও আবেদন জানানো হয়েছে।

অর্থনীতি বনাম ঐতিহ্য

মিশর সরকার বলছে, অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে এবং ২০২৮ সালের মধ্যে ৩ কোটি পর্যটক আকর্ষণ করতে এ ধরনের মেগা-প্রকল্প জরুরি।

কিন্তু ইতিহাস বলছে, সিনাই অঞ্চলের বেদুইনরা বরাবরই উন্নয়ন প্রকল্পে উপেক্ষিত। ১৯৮০-এর দশকে শারম এল-শেখসহ লাল সাগরের রিসোর্টগুলো নির্মাণের সময়ও স্থানীয়দের ব্যবসা ও ভূমি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাংবাদিক মোহান্নাদ সাবরি মনে করেন, এবারও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

সেন্ট ক্যাথরিন মঠ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নানা রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও টিকে আছে। তবে এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিশাল রিসোর্ট প্রকল্পের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বেদুইনদের জীবনধারা এবং এলাকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্থায়ীভাবে বদলে যাবে।

যদিও মঠ ও এর আধ্যাত্মিক মর্যাদা অটুট থাকবে, তবে এর আশপাশের পরিবেশ ও শতাব্দী-প্রাচীন জীবনযাত্রা হয়তো আর আগের মতো থাকবে না।