অদৃশ্য সঙ্গীরা
আমাদের শরীরের ভেতরে ও বাইরে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাক বাস করে। ভয়ঙ্কর শোনালেও, এগুলোই হয়তো আমাদের ঘুম নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নতুন গবেষণা বলছে, এই মাইক্রোবায়োমের গঠন ও বৈচিত্র্য ঘুমের মান ও স্থায়িত্বে প্রভাব ফেলে।
ঘুম ও মাইক্রোবায়োমের দ্বিমুখী সম্পর্ক
অনেক দিন ধরে ধারণা ছিল, ঘুমের সমস্যা শরীরের মাইক্রোবায়োমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সম্পর্কটা উভয় দিকেই কাজ করতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেনিফার মার্টিন বলছেন, নতুন প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে—মাইক্রোবায়োমও ঘুমকে প্রভাবিত করে।

কিশোরদের গবেষণা ফলাফল
সম্প্রতি ঘুমবিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণায় দেখা যায়, যেসব কিশোর ও তরুণদের মুখে মাইক্রোবের বৈচিত্র্য বেশি, তারা তুলনামূলকভাবে বেশি সময় ঘুমায়। অপর দিকে, অনিদ্রায় ভোগা মানুষের অন্ত্রে বৈচিত্র্য কম থাকে, যা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
সামাজিক জেটল্যাগ ও জীবাণুর পরিবর্তন
সপ্তাহের কর্মদিবস আর সাপ্তাহিক ছুটিতে ঘুমের সময়সূচিতে বড় পার্থক্য থাকলে (সামাজিক জেটল্যাগ) অন্ত্রের জীবাণুর গঠনও বদলায়। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রযুক্তি কোম্পানি ‘জোই’-এর তথ্য বলছে, যাদের ঘুমের ধরণ নিয়মিত নয়, তাদের মাইক্রোবায়োম ভিন্ন ধরনের হয়ে যায়।
সার্কাডিয়ান রিদমে প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেনেথ রাইট বলছেন, রাত জাগা, পালাক্রমে কাজ করা বা রাতে দেরিতে খাওয়া সার্কাডিয়ান রিদম নষ্ট করে। এতে হজম সমস্যা ও বিপাকজনিত রোগ দেখা দেয়, আর এর সঙ্গে মাইক্রোবায়োমের পরিবর্তনের যোগ থাকতে পারে।

খাবারের প্রভাব
কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক সারা বেরি বলছেন, ঘুম কম হলে মানুষ অবচেতনে বেশি চিনি খায়। কারণ মস্তিষ্ক তখন দ্রুত শক্তির উৎস খোঁজে। তবে শুধু খাবারের পরিবর্তনেই নয়, সরাসরি কিছু জীবাণুও ঘুমের মান প্রভাবিত করতে পারে।
অন্ত্রের জীবাণু ও রাসায়নিক সংকেত
অন্ত্রের জীবাণু ঘুমের সঙ্গে যুক্ত নানা রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে, যেমন—গামা-অ্যামিনোবিউটারিক, ডোপামিন, নরএপিনেফ্রিন, সেরোটোনিন ও বুটিরেট। এগুলো অন্ত্রে তৈরি হলেও মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। কিন্তু জীবাণুর বৈচিত্র্য কমলে এই রাসায়নিক উৎপাদনও হ্রাস পায়, আর ক্ষতিকর প্রদাহজনিত অণু বাড়তে থাকে।
মুখগহ্বরের জীবাণু ও শ্বাসকষ্টজনিত ঘুমের সমস্যা
খাদ্যাভ্যাস খারাপ বা দাঁতের যত্নে অবহেলা করলে মুখের জীবাণু বেড়ে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এতে শ্বাসকষ্টজনিত ঘুমের সমস্যা (স্লিপ অ্যাপনিয়া) বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
চিকিৎসার সম্ভাবনা
বর্তমানে অনিদ্রার চিকিৎসায় আচরণগত থেরাপি (সিবিটি) ও ওষুধ কার্যকর প্রমাণিত। তবে গবেষকেরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে প্রোবায়োটিক বা প্রিবায়োটিক ঘুমের সমস্যায় নতুন সমাধান দিতে পারে, বিশেষত যাদের দীর্ঘদিনের অনিদ্রা প্রচলিত চিকিৎসায় ভাল হয় না।

সতর্কতা ও ভবিষ্যৎ দিক
অধ্যাপক মার্টিন বলছেন, পরীক্ষিত ওষুধ বা থেরাপির পাশাপাশি নতুন প্রোবায়োটিক পরীক্ষার জন্য বড় আকারের গবেষণা প্রয়োজন। তিনি বিশেষ করে জানতে চান, হালকা মাত্রার স্লিপ অ্যাপনিয়া আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক কোনো সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে কি না।
গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু যদি প্রমাণিত হয় যে মাইক্রোবায়োম ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে, তবে এটি ঘুমের সমস্যায় ভোগা লাখো মানুষের জন্য নতুন আশার পথ খুলে দিতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















