পূর্ব এশিয়ায় জন্মহার আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। শুধু অর্থনৈতিক ব্যয় নয়, সংস্কৃতির চাপও এর বড় কারণ। অভিভাবকদের ওপর সমাজ এমন এক বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে, যেখানে প্রত্যেক সন্তানকে নিখুঁত হতে হবে—অভিনব দক্ষতায় ভরা, পরীক্ষায় সেরা, সামাজিকভাবে স্বীকৃত।
জাপানের জন্মহার ১.১৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ০.৭৫ আর তাইওয়ানে ০.৮৭—সবই বিশ্বের সর্বনিম্নের মধ্যে। তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে জন্মহার ১.৬২, যদিও সেখানেও শিশুর যত্ন ব্যয়বহুল এবং সামাজিক সহায়তা কম।
নিখুঁত সন্তানের বোঝা
এ সংকটকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন “পারফেক্ট চাইল্ড ট্যাক্স”—নিখুঁত সন্তানের জন্য অস্বাভাবিক ব্যয় ও মানসিক চাপ।
২০২৪ সালে জাপানে উচ্চশিক্ষার ব্যয়ের অর্ধেকই বহন করেছেন অভিভাবকেরা—ওইসিডি গড়ের দ্বিগুণের বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাইভেট টিউশনের খরচই প্রায় সমান, যতটা গড় ওইসিডি দেশগুলো তাদের উচ্চশিক্ষায় খরচ করে। এমনকি সাধারণ পরিবারও বছরে প্রায় ২০,০০০ ডলার খরচ করছে একটি সন্তানের কোচিং বা অতিরিক্ত শিক্ষায়।
এখানেই শেষ নয়। জাপানে অনেক মায়ের প্রতিদিনের জমকালো বেন্তো বক্স, সুনির্দিষ্ট মাপে বানানো স্কুল ব্যাগ, অবিরাম পিটিএ চাহিদা—সবকিছু অভিভাবকদের মূল্যায়নের মানদণ্ডে দাঁড় করিয়ে দেয়। এগুলো ব্যক্তিগত পছন্দ নয়, সামাজিক বাধ্যবাধকতা।

লজ্জার সংস্কৃতি বনাম অপরাধবোধের সংস্কৃতি
সিঙ্গাপুরের গবেষক ড. অ্যালেক্সিস হেং বুন চিন এই প্রবণতাকে বলেছেন “কনফুসীয় নীতি।” তাঁর মতে, পশ্চিমে অপরাধবোধ আসে ব্যক্তিগত বিবেক থেকে, কিন্তু কনফুসীয় সংস্কৃতিতে লজ্জা চাপিয়ে দেয় সমাজ। ফলে সন্তান পড়াশোনায় খারাপ করলে সেটি শুধু তার নয়, পুরো পরিবারের সম্মানের ক্ষতি।
মানসিক চাপ ও নতুন প্রজন্মের দ্বিধা
২০২৩ সালের বিগলোব জরিপে দেখা গেছে, জাপানের জেনারেশন জেডের ৫২ শতাংশই মনে করেন তারা সন্তান লালনপালনে আত্মবিশ্বাসী নন। মাত্র ১৭.৭ শতাংশ বলেছেন, অর্থই তাদের প্রধান বাধা। বাকিদের কারণ—সন্তান পালনে আত্মবিশ্বাসের অভাব (৫২.৩%), শিশুদের সঙ্গে অস্বস্তি (৪৫.৯%) এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হারানোর ভয় (৩৬%)।
পরীক্ষাভিত্তিক সংস্কৃতি
এ প্রবণতার শিকড় চীনের প্রাচীন সম্রাটীয় পরীক্ষাব্যবস্থায়, যেখানে শিক্ষাগত সাফল্যই ছিল সামাজিক উন্নতির একমাত্র পথ। আজও গাওকাও (চীন), সুনুং (দক্ষিণ কোরিয়া), জুকেন (জাপান)—এসব ভর্তি পরীক্ষা রাষ্ট্রব্যাপী চাপ তৈরি করে।
সিউলের এক অভিভাবক বললেন, তাঁদের ১৪ বছরের মেয়ে রাত ১১টা পর্যন্ত পড়াশোনা করে। বাবার মন্তব্য—“তার শিক্ষায় খরচ আমাদের গৃহঋণের চেয়েও বেশি।” আরেক সন্তান নেবেন কি না জিজ্ঞেস করলে মা শুধু হেসে বললেন, “একজনই অনেক বেশি।”

একমাত্র সন্তানের ওপর চাপ
অতি নিম্ন জন্মহার অভিভাবকদের সম্পদকে এক সন্তানের ওপর কেন্দ্রীভূত করছে। ফলে সেই শিশুকে নিয়েই গড়ে উঠছে অসহনীয় চাপ। জাপানে ২০২৩ সালে স্কুল ফাঁকি (ফুতোকু) রেকর্ড ৪ লাখ ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। হিকিকোমোরি (সামাজিকভাবে গুটিয়ে থাকা মানুষ) সংখ্যা ১৪.৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। চীনে “লায়িং ফ্ল্যাট” আন্দোলন, কোরিয়ায় “এন-পো প্রজন্ম”—সবই সামাজিক প্রত্যাশার প্রতি প্রতিক্রিয়া।
প্রযুক্তির নতুন ঝুঁকি
ড. চিন সতর্ক করেছেন, সমাজ ধীরে ধীরে প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে নিখুঁত সন্তান তৈরির জন্য। হংকংয়ে ইতিমধ্যে কিছু অভিভাবক সন্তানকে “স্মার্ট ড্রাগ” খাওয়াচ্ছেন। সামনের দিনে আসতে পারে ব্রেইন-চিপ ইমপ্লান্ট, নিউরো-স্টিমুলেশন, এমনকি জেনেটিক প্রযুক্তিতে “ডিজাইনার বেবি।”
কিন্তু এই সমাধান হতে পারে নতুন সংকটের কারণ। এসব প্রযুক্তি ব্যয়বহুল। ফলে যারা দুই বা তার বেশি সন্তান চেয়েছিলেন, তারাও হয়তো শেষমেষ একমাত্র “উন্নত” সন্তানকেই বেছে নেবেন। এতে জন্মহার আরও নেমে যাবে।
করণীয়
এই চক্র ভাঙতে হবে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ধাঁচ পাল্টে।
- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈচিত্র্যময় মেধা মূল্যায়ন করতে হবে।
- কোম্পানিগুলোকে শুধু নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নয়,কাজের দক্ষতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
- জাপানের ছবি-ভিত্তিক সিভি,মর্যাদাভিত্তিক নিয়োগ বা সিনিয়রিটির ভিত্তিতে পদোন্নতি—এসব প্রথা পরিত্যাগ করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিখুঁততার সংস্কৃতি ভাঙা। অভিভাবকদের সুযোগ দিতে হবে “যথেষ্ট ভালো” হওয়ার। শিশুদের সুযোগ দিতে হবে ভুল করার, নিজস্ব পথ খোঁজার।
পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি শুধু জনসংখ্যা হ্রাস নয়, বরং নিখুঁততার জন্য অমানবিক প্রতিযোগিতা। হয়তো এখন সময় এসেছে ভিন্ন পথ বেছে নেওয়ার—যেখানে সাধারণ সন্তানও নিজেদের মতো করে অসাধারণ জীবন গড়তে পারে, আর অভিভাবকরাও স্বস্তির সঙ্গে সন্তান লালন করতে পারেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















