শেফ নাওতো ওহনোর নতুন পথচলা
ফুকুওকার পশ্চিম প্রান্তে ছোট্ট রেস্তোরাঁ ‘সিন’। মাত্র আট আসনের বাঁকানো কাউন্টারে বসেই শুরু হয় বিশ্ব ভ্রমণ। ১৪ পদবিশিষ্ট মেন্যুতে প্রতিটি খাবারের উৎসের স্থানাঙ্ক দেওয়া থাকে—কোথাও ডেনমার্ক, কোথাও মরক্কো, আবার লাওস। এভাবেই শেফ-ওনার নাওতো ওহনো, বয়স ৩৬, ফরাসি খাবারকে বিশ্বায়িত করে তুলেছেন।
ফুকুওকায় জন্ম নেওয়া ওহনো কিশোর বয়সেই নিউ ইয়র্কে যান কুলিনারি ইনস্টিটিউট অব আমেরিকায় পড়তে। পরে টোকিওর কুইন্টেসেন্স ও কিয়োটোর মিজাই, তিন মিশেলিন-তারকাপ্রাপ্ত রেস্তোরাঁয় খেয়ে তাঁর জীবনের লক্ষ্য পাল্টে যায়। উচ্চমানের ফাইন ডাইনিং হয়ে ওঠে তাঁর প্যাশন।
কঠিন রান্নাঘর থেকে শেখা
২০১৪ সালে ওহনো যোগ দেন শিকাগোর বিখ্যাত ‘আলিনিয়া’ রেস্তোরাঁয়। সেখানে তিনি ছিলেন একমাত্র বিদেশি কর্মী, শুরুতে ঠান্ডা খাবার প্রস্তুতকারী হিসেবে কাজ শুরু করে পরে ওঠেন পেস্ট্রি শেফ পদে। প্রতিদিন ৯০ জন অতিথি, বছরের সব দিন রেস্তোরাঁ পূর্ণ। এই কঠিন পরিবেশেই তৈরি হয় তাঁর দক্ষতা।
এরপর শুরু হয় ঘুরে বেড়ানো—ইউরোপের নানা রেস্তোরাঁয় কাজ, নেদারল্যান্ডসের দে লিব্রিজি থেকে ইতালির সাধারণ ট্রাতোরিয়া পর্যন্ত। সবই অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য।
স্বপ্নের রেস্তোরাঁ ‘সিন’
২০২০ সালের মহামারি ওহনোর পেরুতে ইন্টার্নশিপ থামিয়ে দেয়। দেশে ফিরে তিনি ফ্রিল্যান্স শেফ ও বারটেন্ডার হিসেবে কাজ করেন। ২০২২ সালে RED U-35 প্রতিযোগিতায় ফাইনালিস্ট হয়ে তিনি নিজের রেস্তোরাঁর ধারণা স্পষ্ট করেন—‘Cuisine et Voyage’ বা রান্না ও ভ্রমণের মেলবন্ধন।
অবশেষে ২০২৩ সালের জুনে খুলে যায় ‘সিন’। নামের উৎস ‘সিম্ফনি’, ‘সিঙ্ক্রোনাইজেশন’ ও ‘সিনেসথেসিয়া’। প্রতিটি খাবারের শুরু হয় ‘আকুয়া ভিটায়ে’ দিয়ে—ফেজান্ট, হাঁস ও সিলকি মুরগির কনসোমে, যা তৈরি হয় বিশেষ ক্ষারীয় খনিজ পানিতে।
সৃজনশীলতার স্বাদ
মেন্যুর প্রতিটি পদ যেন একেকটি ভ্রমণ।
- “ইম্প্রোভাইজেশন”: আচারি ডাইকন মোড়ানো সার্ডিন, হামাগুরি ক্ল্যাম ও দ্বীপীয় শ্যালট।
- “অ্যাপল”: হাতে তৈরি ক্ষুদ্র আপেল, ভেতরে অ্যাপলজ্যাক স্বাদের ফোয়া গ্রা, পরিবেশন করা হয় একটি বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের লোগো খচিত প্লেটে।
- “অ্যামনিওটিক ফ্লুইড”: সাগরকে জীবনের জননী হিসেবে উপস্থাপন। লাল-দাগযুক্ত গ্রুপার মাছ ও হ্যামো কনসোমে রিসোত্তো—অর্ধেক রান্না করা মাছের প্রাকৃতিক উমামি রক্ষায় শেফের নিখুঁত কৌশল।
আরও আছে ইতালির ভ্যালটেলিনার শুকনো গরুর মাংস, ফুকুওকার ভাত দিয়ে তৈরি প্রন কনসোমে পায়েয়া, আর প্রধান পদ হিসেবে কাঠে পোড়া নিখুঁত ‘মিস্টার নিশিয়ামা ওয়াগিউ’।
ডেজার্টে নতুন ভাবনা
ডেজার্টের দায়িত্ব নেন পেস্ট্রি শেফ নামি এজাকি। তিনি ঐতিহ্যবাহী ভারী সিরাপ-ভেজানো ফরাসি ‘সাভারিন’কে রূপ দেন হালকা গ্রীষ্মকালীন মিষ্টান্নে। তাজা সাইট্রাস ফল, উলং চা ও আদার সংমিশ্রণে তৈরি এই কেক আনে ভিন্ন স্বাদ।
সরবরাহকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা
‘সিন’-এর মেন্যুতে সরবরাহকারীদের নাম লেখা হয় “সহযোগী” হিসেবে। ২০১৭ সালে এক দুর্ঘটনায় হাতে স্নায়ু কেটে গেলে ওহনো রান্না করতে পারেননি। তখন তিনি কৃষক ও জেলেদের সঙ্গে কাজ করতে যান এবং উপলব্ধি করেন উপকরণের পেছনের কঠোর শ্রম। সেই থেকে তিনি প্রতিটি সরবরাহকারীর প্রতি গভীর সম্মান প্রদর্শন করেন।
চ্যালেঞ্জ ও দর্শন
ফুকুওকায় উচ্চমানের রেস্তোরাঁ মানেই সাধারণত সুশি বা ফরাসি-জাপানি সংমিশ্রণ। তাই ‘সিন’-এর ভিন্নধর্মী পরিচয় এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে। মাঝে মাঝে তাই আ লা কার্ত মেন্যুও চালু করতে হয়।
তবে ওহনো এসব সংজ্ঞায় আবদ্ধ নন। তাঁর মতে, ফরাসি খাবার বিশ্বজুড়ে নানা কৌশল ও সংস্কৃতি থেকে তৈরি—এটি স্বাধীনতার রান্না।