০১:১৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

একমুখী সড়ক: বিজ্ঞান কূটনীতি

২১শ শতকে বিজ্ঞান, কূটনীতি ও রাষ্ট্রনীতি একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ছে। আগে যেখানে বিজ্ঞান শুধুই ল্যাব বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা এবং চুক্তি আলোচনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বা খনিজ সম্পদ আহরণের মতো প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

তবে “বিজ্ঞান কূটনীতি” এখনও পর্যাপ্তভাবে প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ অঞ্চলে। এই প্রবন্ধটি দেখায় কীভাবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কখনও সহযোগিতার পথ তৈরি করে, আবার কখনও কৌশলগত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।


বিজ্ঞান ও কূটনীতির সম্পর্কের বিবর্তন

বিজ্ঞানীদের অনেকেই গবেষণা থেকে নীতিনির্ধারণে প্রবেশ করেছেন। নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা, কৃষি গবেষণা কিংবা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক ফোরামে দেশের প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়িয়েছেন।

এটি একটি একমুখী ধারা তৈরি করেছে—বিজ্ঞান কূটনীতিকে প্রভাবিত করছে, কিন্তু কূটনীতি বিজ্ঞানের মূল ধারা নির্ধারণ করছে না। এই প্রবণতা দেখায় আন্তর্জাতিক আলোচনায় বিশ্বাসযোগ্য ভূমিকা রাখতে হলে গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন।

বৈশ্বিক আলোচনায় বিজ্ঞানের গুরুত্ব

নিউক্লিয়ার অস্ত্র সীমিতকরণ, মহাকাশ গবেষণা, সমুদ্রসম্পদ ভাগাভাগি বা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ—এসব আলোচনায় বিজ্ঞান ছাড়া কূটনীতি সম্ভব নয়।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০ সালের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT) বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ছাড়া সম্ভব হত না। তবে এতে বৈষম্য তৈরি হয়েছিল—নির্দিষ্ট তারিখের আগে যারা পারমাণবিক শক্তি অর্জন করেছিল, তারাই বিশেষ মর্যাদা পায়, অন্যরা বাদ পড়ে।

আজ একইভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে। এর নিরাপত্তা, নৈতিকতা এবং জাতীয় স্বার্থকে কীভাবে সামঞ্জস্য করা হবে, তা নির্ধারণে বিজ্ঞানীদের অবদান অপরিহার্য।


বিজ্ঞানের বাণিজ্যিকীকরণ ও কূটনৈতিক প্রভাব

বিজ্ঞান এখন শুধু জ্ঞানের ক্ষেত্র নয়, বরং অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অস্ত্রও। সেমিকন্ডাক্টর, রেয়ার আর্থ খনিজ বা উন্নত প্রযুক্তি—এসব শুধু বাজার দখল নয়, বৈশ্বিক প্রভাবের হাতিয়ার।

টিকা উৎপাদনের উদাহরণ দেখায় যে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কেবল দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক সম্মানও এনে দেয়। কোভিড মহামারির সময় যে দেশ সাশ্রয়ী ও কার্যকর টিকা সরবরাহ করতে পেরেছে, তা বহু বছরের বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো গড়ার ফল।


শান্তির সেতু হিসেবে বিজ্ঞান

অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি এর অন্যতম উদাহরণ। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়েও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় একসাথে কাজ করেছে। এটি দেখায় যে বিজ্ঞান রাজনৈতিক বিভাজনের মাঝেও সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করতে পারে।

তবে আর্কটিক অঞ্চলে পরিস্থিতি ভিন্ন। সামরিকীকরণ ও সম্পদ প্রতিযোগিতা সেখানে বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ন করেছে।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো

অনেক দেশের দূতাবাসে এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অ্যাটাশে কাজ করেন, যারা স্থানীয় গবেষকদের সঙ্গে সমন্বয় করেন। এছাড়া জলবায়ু, স্বাস্থ্য, মহাকাশ ইত্যাদি বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি পরিচালনার জন্য সরকারি বিভাগ রয়েছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান কূটনীতির গুরুত্ব এখনও সীমিতভাবে আলোচনা হয়।

ভূ-রাজনীতির প্রভাবে বিজ্ঞান

আদর্শভাবে বিজ্ঞান রাজনীতিমুক্ত হওয়া উচিত, কিন্তু বাস্তবে তা ক্রমশ প্রভাবিত হচ্ছে। তথ্য বিনিময়, মহাকাশ প্রযুক্তি বা জলসম্পদ ভাগাভাগি প্রায়ই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে ভেঙে পড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হলে যৌথ জলবিদ্যা গবেষণা বন্ধ হয়ে গেছে। জলবায়ু সহযোগিতার ক্ষেত্রেও এমন সংকট দেখা যায়।


ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ

অ্যান্টার্কটিকার মতো কিছু বিশেষ চুক্তি শক্তিশালী হলেও বৈশ্বিক কাঠামো যেমন জলবায়ু সম্মেলন—সেখানে বৈজ্ঞানিক মতামত প্রায়ই রাজনৈতিক সমঝোতায় দুর্বল হয়ে পড়ে।

যেমন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এক ডিগ্রি, দেড় ডিগ্রি বা দুই ডিগ্রি উষ্ণায়নের পার্থক্য স্পষ্ট করেছে। কিন্তু কূটনৈতিক আলোচনায় অর্থনৈতিক দায়ভার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সামনে আসায় বৈজ্ঞানিক সুপারিশকে দুর্বল করা হয়েছে।

আজকের পৃথিবীতে বিজ্ঞানের অবদান ছাড়া আন্তর্জাতিক শাসন কল্পনা করা যায় না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকাশ গবেষণা থেকে সমুদ্রতল খনন—সব জায়গায় বিজ্ঞান অপরিহার্য।

তবে এর কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে বিজ্ঞানকে রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে আংশিক মুক্ত রাখতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। বিজ্ঞান কূটনীতি কোনো পরিপূরক নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো।

একমুখী সড়ক: বিজ্ঞান কূটনীতি

১০:১৮:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

২১শ শতকে বিজ্ঞান, কূটনীতি ও রাষ্ট্রনীতি একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ছে। আগে যেখানে বিজ্ঞান শুধুই ল্যাব বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা এবং চুক্তি আলোচনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বা খনিজ সম্পদ আহরণের মতো প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

তবে “বিজ্ঞান কূটনীতি” এখনও পর্যাপ্তভাবে প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ অঞ্চলে। এই প্রবন্ধটি দেখায় কীভাবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কখনও সহযোগিতার পথ তৈরি করে, আবার কখনও কৌশলগত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।


বিজ্ঞান ও কূটনীতির সম্পর্কের বিবর্তন

বিজ্ঞানীদের অনেকেই গবেষণা থেকে নীতিনির্ধারণে প্রবেশ করেছেন। নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা, কৃষি গবেষণা কিংবা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক ফোরামে দেশের প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়িয়েছেন।

এটি একটি একমুখী ধারা তৈরি করেছে—বিজ্ঞান কূটনীতিকে প্রভাবিত করছে, কিন্তু কূটনীতি বিজ্ঞানের মূল ধারা নির্ধারণ করছে না। এই প্রবণতা দেখায় আন্তর্জাতিক আলোচনায় বিশ্বাসযোগ্য ভূমিকা রাখতে হলে গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন।

বৈশ্বিক আলোচনায় বিজ্ঞানের গুরুত্ব

নিউক্লিয়ার অস্ত্র সীমিতকরণ, মহাকাশ গবেষণা, সমুদ্রসম্পদ ভাগাভাগি বা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ—এসব আলোচনায় বিজ্ঞান ছাড়া কূটনীতি সম্ভব নয়।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০ সালের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT) বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ছাড়া সম্ভব হত না। তবে এতে বৈষম্য তৈরি হয়েছিল—নির্দিষ্ট তারিখের আগে যারা পারমাণবিক শক্তি অর্জন করেছিল, তারাই বিশেষ মর্যাদা পায়, অন্যরা বাদ পড়ে।

আজ একইভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে। এর নিরাপত্তা, নৈতিকতা এবং জাতীয় স্বার্থকে কীভাবে সামঞ্জস্য করা হবে, তা নির্ধারণে বিজ্ঞানীদের অবদান অপরিহার্য।


বিজ্ঞানের বাণিজ্যিকীকরণ ও কূটনৈতিক প্রভাব

বিজ্ঞান এখন শুধু জ্ঞানের ক্ষেত্র নয়, বরং অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অস্ত্রও। সেমিকন্ডাক্টর, রেয়ার আর্থ খনিজ বা উন্নত প্রযুক্তি—এসব শুধু বাজার দখল নয়, বৈশ্বিক প্রভাবের হাতিয়ার।

টিকা উৎপাদনের উদাহরণ দেখায় যে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কেবল দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক সম্মানও এনে দেয়। কোভিড মহামারির সময় যে দেশ সাশ্রয়ী ও কার্যকর টিকা সরবরাহ করতে পেরেছে, তা বহু বছরের বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো গড়ার ফল।


শান্তির সেতু হিসেবে বিজ্ঞান

অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি এর অন্যতম উদাহরণ। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়েও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় একসাথে কাজ করেছে। এটি দেখায় যে বিজ্ঞান রাজনৈতিক বিভাজনের মাঝেও সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করতে পারে।

তবে আর্কটিক অঞ্চলে পরিস্থিতি ভিন্ন। সামরিকীকরণ ও সম্পদ প্রতিযোগিতা সেখানে বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ন করেছে।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো

অনেক দেশের দূতাবাসে এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অ্যাটাশে কাজ করেন, যারা স্থানীয় গবেষকদের সঙ্গে সমন্বয় করেন। এছাড়া জলবায়ু, স্বাস্থ্য, মহাকাশ ইত্যাদি বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি পরিচালনার জন্য সরকারি বিভাগ রয়েছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান কূটনীতির গুরুত্ব এখনও সীমিতভাবে আলোচনা হয়।

ভূ-রাজনীতির প্রভাবে বিজ্ঞান

আদর্শভাবে বিজ্ঞান রাজনীতিমুক্ত হওয়া উচিত, কিন্তু বাস্তবে তা ক্রমশ প্রভাবিত হচ্ছে। তথ্য বিনিময়, মহাকাশ প্রযুক্তি বা জলসম্পদ ভাগাভাগি প্রায়ই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে ভেঙে পড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হলে যৌথ জলবিদ্যা গবেষণা বন্ধ হয়ে গেছে। জলবায়ু সহযোগিতার ক্ষেত্রেও এমন সংকট দেখা যায়।


ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ

অ্যান্টার্কটিকার মতো কিছু বিশেষ চুক্তি শক্তিশালী হলেও বৈশ্বিক কাঠামো যেমন জলবায়ু সম্মেলন—সেখানে বৈজ্ঞানিক মতামত প্রায়ই রাজনৈতিক সমঝোতায় দুর্বল হয়ে পড়ে।

যেমন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এক ডিগ্রি, দেড় ডিগ্রি বা দুই ডিগ্রি উষ্ণায়নের পার্থক্য স্পষ্ট করেছে। কিন্তু কূটনৈতিক আলোচনায় অর্থনৈতিক দায়ভার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সামনে আসায় বৈজ্ঞানিক সুপারিশকে দুর্বল করা হয়েছে।

আজকের পৃথিবীতে বিজ্ঞানের অবদান ছাড়া আন্তর্জাতিক শাসন কল্পনা করা যায় না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকাশ গবেষণা থেকে সমুদ্রতল খনন—সব জায়গায় বিজ্ঞান অপরিহার্য।

তবে এর কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে বিজ্ঞানকে রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে আংশিক মুক্ত রাখতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। বিজ্ঞান কূটনীতি কোনো পরিপূরক নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো।