রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন অধ্যায়
২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলোপের পর থেকে নেপাল ইতিমধ্যে ১৪টি সরকার দেখেছে। তবে চলতি মাসে কাঠমান্ডু ও অন্যান্য শহরে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল, তা অভূতপূর্ব। ৮ সেপ্টেম্বর সরকারবিরোধী দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভে কমপক্ষে ১৯ তরুণ নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান বলে অভিযোগ। এরপরদিন প্রধানমন্ত্রী খড়গপ্রসাদ শর্মা ওলি পদত্যাগ করেন। কিন্তু এই পদক্ষেপে জনতা সন্তুষ্ট হয়নি; বরং ক্ষোভ আরও বেড়ে যায় এবং পরদিনই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

সহিংসতায় রাজধানী পুড়ল
বিক্ষুব্ধ জনতা সংসদ ভবন, সরকারি অফিস এবং রাজনীতিবিদদের বাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী অগ্নিকাণ্ডে গুরুতর দগ্ধ হন বলে জানা গেছে। অনেক রাজনীতিবিদকে রাস্তায় মারধর করা হয়। কারাগারে হামলা চালিয়ে হাজারো বন্দিদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী কারফিউ জারি করে, যা প্রথমে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘোষণা করা হলেও দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ
এই আন্দোলনের তাৎক্ষণিক সূত্রপাত ৪ সেপ্টেম্বর সরকারের এক ঘোষণায়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারের দাবি ছিল—নতুন বিধি অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন না করায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যদিও পরে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়, কিন্তু তরুণদের ক্ষোভ দমে যায়নি।

বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও দুর্নীতিতে জনঅসন্তোষ
প্রতি ব্যক্তির আয় (২০২৪ সালে মাত্র ১,৪৪৭ ডলার) অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে কম। কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতি পাঁচ তরুণের একজন বেকার। দুর্নীতি সর্বব্যাপী। অনেক তরুণ বিদেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, ফলে প্রবাসী আয়ের ওপরই দেশের এক-চতুর্থাংশ অর্থনীতি নির্ভর করছে। এদিকে রাজনীতিবিদদের বিলাসবহুল জীবনযাপন ও তাদের সন্তানদের বিদেশ ভ্রমণের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়।
‘জেনারেশন জেড’ আন্দোলন
তরুণ প্রজন্মের এই বিক্ষোভকে বলা হচ্ছে “জেনারেশন জেড মুভমেন্ট”। তারা দাঙ্গা ও লুটপাট থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করছে এবং অন্তত কিছু অংশের দাবি, সহিংসতায় মাওবাদী অনুপ্রবেশকারীরা জড়িত। ১০ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের প্রতিনিধিরা সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। তারা দাবি তোলে—একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে, যেখানে পেশাদার রাজনীতিবিদদের স্থান থাকবে না।

সম্ভাব্য নেতৃত্বে সুসিলা কার্কি
এই সরকারের নেতৃত্বে প্রস্তাবিত নামের মধ্যে রয়েছেন সুসিলা কার্কি, যিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে রাজপথে উপস্থিত ছিলেন। তবে এই প্রস্তাব গৃহীত হবে কিনা, তা এখনো পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলছে। কেউ কেউ এই অস্থিরতাকে রাজতন্ত্র পুনর্বহালের সুযোগ হিসেবেও দেখছেন।
আঞ্চলিক প্রভাব
ভারত নেপালের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং দীর্ঘদিন ধরে দেশটিকে প্রভাবিত করে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের প্রভাব বাড়ছে, বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে। ওলিকে অনেকেই চীনপন্থী হিসেবে দেখতেন। ফলে ভারতের জন্য এই অস্থিরতা উদ্বেগজনক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা বৈঠক ডেকে নেপালের স্থলসীমান্ত বন্ধের নির্দেশ দেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্রোহের ধারা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় বিদ্রোহ রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছে। গত বছর বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পতন ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যারা ২০২৬ সালে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। তিন বছর আগে শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার ভাই মাহিন্দা ক্ষমতাচ্যুত হন। নেপাল অতীতে বহুবার রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগ হারিয়েছে। এবার ৩ কোটি নেপালি আশা করছে—তাদের নেতারা এই নতুন সুযোগ কাজে লাগাবেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















