বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। শত শত নদ-নদী এ দেশের প্রাণ, যেগুলো মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে বহুমাত্রিকভাবে প্রভাবিত করেছে। ঝালকাঠি জেলার হালতা নদীও তেমনি একটি নদী। হয়তো এটি পদ্মা বা মেঘনার মতো বিশাল নয়, কিন্তু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে এটি শুধু একটি নদী নয়, বরং এক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে নৌ-যোগাযোগ, জেলেদের জীবিকা থেকে মানুষের সংস্কৃতিতে হালতা নদীর প্রভাব সুদীর্ঘ।
হালতা নদীর অবস্থান ও প্রবাহ
হালতা নদী ঝালকাঠি জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ নদীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে একাধিক খাল ও ছোট নদী, যেগুলো মিলিত হয়ে একটি জলজ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি ফুলে ওঠে, চারপাশের জমিকে ভরিয়ে দেয়। শীতকালে এ নদী সরু হয়ে আসে, কিন্তু সারা বছরই এটি স্থানীয় কৃষক, জেলে ও নৌযাত্রীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার এবং এটি জেলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রামকে সংযুক্ত করেছে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
স্থানীয় প্রবীণদের ভাষ্য অনুযায়ী, হালতা নদী একসময় ছিল ঝালকাঠির প্রাণকেন্দ্র। নৌকাই ছিল প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম। বিয়ের শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে গ্রামের হাট-বাজারে পণ্য পরিবহন—সবই হতো হালতা নদীর মাধ্যমে। আশপাশের গ্রামে গড়ে উঠেছিল ঘাট, যেখানে নৌকা বেঁধে যাত্রীরা নামতেন।
গ্রামের ৮০ বছর বয়সী প্রবীণ হাশেম আলী বলেন—
“আমরা ছোটবেলায় দেখতাম হালতা নদীতে সারি সারি পালতোলা নৌকা ভেসে থাকত। বিয়ের শোভাযাত্রা যেত নদীপথে। তখনকার দিনে হালতা নদী ছাড়া জীবন কল্পনা করা যেত না।”
বলা হয়, উনিশ শতকেই এ নদী ঝালকাঠির গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ডে পরিণত হয়েছিল। মাছ, ধান, নারকেল, সুপারি ও কাঠ হালতা নদীপথে পরিবাহিত হতো। এমনকি দূর-দূরান্তের বণিকেরাও এ নদী ব্যবহার করতেন।
অর্থনীতি ও কৃষিতে ভূমিকা
হালতা নদী এখনো স্থানীয় কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ। বর্ষায় নদীর পানি জমিতে এসে উর্বরতা বৃদ্ধি করে। শুষ্ক মৌসুমে অনেক কৃষক নদীর পানি সেচের কাজে ব্যবহার করেন। পানের বরজ, ধান, শাকসবজি এবং অন্যান্য ফসল উৎপাদনে হালতা নদীর পানি অপরিহার্য।
স্থানীয় কৃষক আবদুল মালেকের ভাষ্য—
“আমাদের জমি অনেকটা হালতা নদীর ওপর নির্ভরশীল। বর্ষায় নদীর পানি জমিকে উর্বর করে, আবার শুষ্ক মৌসুমে সেই নদীর পানিই সেচে কাজে লাগে।”
অন্যদিকে, নদীটি মাছের জন্যও পরিচিত। রুই, কাতলা, শিং, মাগুরসহ নানা প্রজাতির দেশি মাছ একসময় এ নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। যদিও এখন এ সম্পদ অনেকটাই কমে গেছে, তবুও স্থানীয় জেলেরা এখনো নদীর সঙ্গে জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
জেলে মিজানুর রহমান বলেন—
“আগে এক রাত জাল ফেললেই দুই মণ মাছ উঠত। এখন পুরো রাত বসে থাকলেও আধা মণ মাছ পাই না। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, মাছ কমছে।”
নৌযাত্রা ও যোগাযোগ
হালতা নদী ঝালকাঠির গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। একসময় যখন সড়কপথ উন্নত হয়নি, তখন গ্রামের মানুষ নৌকা দিয়ে এপাড়-ওপাড় যেতেন। কৃষকরা বাজারে পণ্য নিয়ে যেতেন নৌকায়, আবার ছাত্র-শিক্ষকরা নৌকায় করেই বিদ্যালয়ে যেতেন।
এখন সড়ক যোগাযোগ অনেক উন্নত হয়েছে, কিন্তু নৌপথের গুরুত্ব পুরোপুরি শেষ হয়নি। বর্ষাকালে এখনো নৌকা স্থানীয়দের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম।
সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব
বাংলাদেশের অনেক নদীর মতো হালতা নদীও লোকজ সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। বর্ষার সময় নদীতে পালতোলা নৌকার প্রতিযোগিতা হতো, যাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ মেলা বসত। অনেক লোকগান, কবিতা ও গল্পে হালতা নদীর নাম উঠে এসেছে।
এছাড়া, নদীটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে জেলে সম্প্রদায়ের বসতি। তারা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তাঁদের জীবনযাত্রা, সুখ-দুঃখ, উৎসব—সবই নদীকে ঘিরে।
স্থানীয় লোকগানে এখনো শোনা যায়—
“হালতা নদীর পাড়ে বসে, জেলের গান শোনা যায়,
মেঘলা আকাশে ভেসে চলে নৌকা, সবার মনে আনন্দ ছায়া।”
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য
হালতা নদী শুধু মানুষের নয়, জীববৈচিত্র্যেরও আশ্রয়। নদীতে মাছ, শামুক, কাঁকড়া ও নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ রয়েছে। নদীর তীরে গড়ে ওঠা গাছপালা স্থানীয় পরিবেশকে শীতল রাখে। তবে নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, পলি জমে যাওয়া ও দূষণের কারণে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
একটি স্থানীয় পরিবেশ সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে নদীতে দেশি মাছের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে।
বর্তমান সংকট
আজকের হালতা নদী আগের মতো নেই। কয়েকটি বড় সমস্যা নদীটিকে সংকটে ফেলেছে—
পলি জমা: বর্ষায় প্রচুর পলি এসে নদীর তলদেশ ভরাট করছে। ফলে নদীর গভীরতা কমছে।দখল: নদীর দুই তীরে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল দখল করে বসতি ও ব্যবসা গড়ে তুলেছে।দূষণ: কৃষিজমি থেকে আসা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নদীতে গিয়ে পড়ছে। ফলে মাছ ও জলজ প্রাণী মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।শুকিয়ে যাওয়া: শীতকালে নদীর অনেক অংশ প্রায় পানিশূন্য হয়ে যায়। এতে নৌযান চলাচল বন্ধ হয় এবং কৃষিতে পানি সংকট দেখা দেয়।
স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা
স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায় বোঝা যায়, নদীর অবনতি তাঁদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলছে। জেলে পরিবারের আয় কমে গেছে, কৃষকরা পর্যাপ্ত সেচপানি পাচ্ছেন না, আর নৌযাত্রার সুবিধাও অনেক কমে গেছে।
স্থানীয় গৃহিণী রাবেয়া বেগম বলেন—
“আগে নদীর পাড়ে বসেই আমরা বাজার করতে পারতাম। এখন নদী এত সরু হয়ে গেছে যে, নৌকা ঢুকতেই চায় না।”
অন্যদিকে, বৃদ্ধ আবদুল গফুরের আফসোস—
“আগে হালতায় যে মাছ পাওয়া যেত, এখন আর পাই না। নদীটা যদি আগের মতো থাকত, আমাদের জীবন অনেক সহজ হতো।”
ভবিষ্যতের করণীয়
হালতা নদীকে বাঁচাতে কিছু উদ্যোগ জরুরি—
- নদী খনন করে এর স্বাভাবিক গভীরতা ফিরিয়ে আনা।
- নদী দখলমুক্ত করা এবং আইনের আওতায় আনা।
- দূষণ রোধে সচেতনতা ও বিকল্প কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- নদীতীরবর্তী এলাকায় বৃক্ষরোপণ করা।
- স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে নদী রক্ষার আন্দোলন তৈরি করা।
স্থানীয় শিক্ষাবিদ আবুল কাসেম বলেন—
“নদী রক্ষা মানে শুধু পানি সংরক্ষণ নয়; এটি আমাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি আর ভবিষ্যৎকে বাঁচানো।”
হালতা নদী ঝালকাঠির মানুষের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনের অংশ। কিন্তু এ নদী আজ সংকটে। যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া গেলে নদীটির ঐতিহ্য ও জীবনদায়ী ভূমিকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণও এখানে জরুরি। হালতা নদীকে বাঁচানো মানে শুধু একটি নদীকে রক্ষা করা নয়, বরং একটি অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা।