মেনোপজ–পরবর্তী নারীদের জন্য হরমোন থেরাপি বহু বছর ধরে বিভিন্ন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ সম্প্রতি সব ধরনের হরমোন থেরাপি থেকে ব্ল্যাক-বক্স সতর্কতা তুলে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। এ সিদ্ধান্ত অনেক নারীর মধ্যে নতুন প্রশ্ন ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কিছু বিশেষজ্ঞ এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন, আবার দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বলছেন—এ সিদ্ধান্ত হয়তো আগেভাগে নেওয়া হয়েছে।
হরমোন থেরাপির পটভূমি
মেনোপজের সময় ইস্ট্রোজেন কমে গেলে গরম ভাব, যোনি শুষ্কতা, অস্বস্তি এবং হাড় ক্ষয়ের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এই সমস্যাগুলো কমাতে একসময় ব্যাপকভাবে হরমোন থেরাপি ব্যবহার হতো।
২০০৩ সালে উইমেন’স হেলথ ইনিশিয়েটিভ (WHI) গবেষণায় দেখা যায়—কিছু ধরনের হরমোন থেরাপি রক্ত জমাট, স্ট্রোক এবং স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এর পর থেকেই থেরাপির ব্যবহার দ্রুত কমে যায়।
যদিও পরবর্তীতে স্পষ্ট হয়—এসব ঝুঁকি মূলত অনেক বয়স্ক এবং মেনোপজের বহু বছর পর থাকা নারীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়, তবু সতর্কতা কঠোরই রয়ে যায়।
এফডিএ–র নতুন ঘোষণা: কেন বিতর্ক
এফডিএ জানিয়েছে—সব ধরনের হরমোন থেরাপি থেকে ব্ল্যাক-বক্স সতর্কতা সরানোর সময় এসেছে। চিকিৎসকেরা মনে করেন—হরমোন থেরাপি বহু বছর ধরেই কম ব্যবহৃত হচ্ছে, ফলে সতর্কতার পুনর্মূল্যায়ন জরুরি ছিল। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন—সব হরমোন পণ্যের ঝুঁকি এক নয়। বিভিন্ন পণ্যের জন্য আলাদা সতর্কতা প্রয়োজন ছিল, যা এফডিএ করেনি।
স্থানীয় ইস্ট্রোজেন থেরাপি: ঝুঁকি কম, উপকার বেশি
স্থানীয় বা লো-ডোজ ইস্ট্রোজেন সাধারণত যোনি অঞ্চলে ব্যবহার করা হয় এবং এটি যোনির শুষ্কতা, বারবার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ ও মেনোপজ–পরবর্তী অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭০% থেকে ৮০% নারী এসব সমস্যায় ভোগেন এবং এই থেরাপি রক্তে খুব কম শোষিত হওয়ায় ঝুঁকিও অত্যন্ত কম। এমনকি পূর্বে স্তন ক্যানসার থাকা অনেক নারীর ক্ষেত্রেও এটি নিরাপদ বলে বিবেচিত।
ব্ল্যাক-বক্স সতর্কতার কারণে বহু নারী ওষুধ নিতে দ্বিধায় ছিলেন। ফলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—এই সতর্কতা অনেক আগেই সরানো উচিত ছিল।
সিস্টেমিক ইস্ট্রোজেন থেরাপি: বিস্তৃত উপসর্গের চিকিৎসা
সিস্টেমিক ইস্ট্রোজেন রক্তে শোষিত হয়ে পুরো শরীরে কাজ করে। পিল, প্যাচ, জেল বা স্প্রের মাধ্যমে এটি দেওয়া হয় এবং জরায়ুর সুরক্ষার জন্য প্রোজেস্টেরনও যুক্ত করা হয়। এই থেরাপি গরম ভাব, রাতের ঘাম এবং হাড় ক্ষয় কমাতে ভূমিকা রাখে।
তবে উপকার পেতে হলে নিশ্চিত হতে হবে—উপসর্গগুলো সত্যিই মেনোপজ–সম্পর্কিত কি না।
ব্ল্যাক-বক্স সতর্কতা নিয়ে বিতর্ক
বিশেষজ্ঞদের মতে, সব ধরনের ইস্ট্রোজেন পণ্যকে একই সতর্কতার আওতায় রাখা উচিত নয়। মুখে খাওয়া ইস্ট্রোজেন রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায়, কিন্তু স্থানীয় ইস্ট্রোজেন বা বিভিন্ন উৎস থেকে তৈরি ইস্ট্রোজেনের ঝুঁকি ভিন্ন হতে পারে।
WHI গবেষণায় ব্যবহৃত ঘোড়ার মূত্র থেকে তৈরি ইস্ট্রোজেন প্রোজেস্টেরন ছাড়া নিলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমতে পারে—এমন তথ্যও পরবর্তীতে উঠে এসেছে।
এই কারণে অনেক বিশেষজ্ঞের মন্তব্য—প্রতিটি পণ্যের জন্য আলাদা নির্দেশনা জরুরি ছিল।
কে সিস্টেমিক ইস্ট্রোজেন নেবেন
মেনোপজের আগে-পরে গুরুতর উপসর্গে ভোগা নারীরা চিকিৎসকের পরামর্শে সিস্টেমিক ইস্ট্রোজেন নিতে পারেন। মেনোপজের সময়ের কাছাকাছি থেরাপি শুরু করলে উপকার বেশি দেখা যায়।
তবে ৬০ বছরের বেশি বয়সে বা মেনোপজের বহু বছর পর থেরাপি শুরু করলে ঝুঁকি বাড়তে পারে।
কিছু দাবি রয়েছে—হরমোন থেরাপি দীর্ঘায়ু, হৃদ্রোগ প্রতিরোধ এবং স্মৃতিশক্তি রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনো স্পষ্ট ও একমত গবেষণা নেই।
কারা সিস্টেমিক ইস্ট্রোজেন নেবেন না
বয়স্ক নারী, মেনোপজের ১০ বছর পার হয়ে যাওয়া নারীরা, যাদের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা গুরুতর লিভার রোগের ইতিহাস আছে—তাদের সাধারণত সিস্টেমিক ইস্ট্রোজেন এড়াতে বলা হয়।
যাদের রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা আছে বা যারা হরমোন–সংবেদনশীল ক্যানসার, বিশেষ করে স্তন ক্যানসারে ভুগেছেন—তাদের ক্ষেত্রেও এ থেরাপি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
অনেক বিশেষজ্ঞ উদ্বেগ জানিয়েছেন—ভুল বার্তা ছড়ালে রোগীরা বিপদে পড়তে পারেন।
ব্ল্যাক-বক্স সতর্কতা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও, বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশ মনে করেন—হরমোন থেরাপির প্রবেশাধিকার বাড়লে বহু নারী উপকৃত হবেন।
কিছু উপকার হয়তো অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে, তবে সতর্কভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সঠিক রোগী নির্বাচন করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
# স্বাস্থ্য #মেনোপজ #হরমোন_থেরাপি #নারীস্বাস্থ্য #এফডিএ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















