যে দেশের রমণীগণ অতি নিরীহভাবে আপনাদিগের ক্ষুদ্র সংসার-জগতে নীরবে দিন কাটাইয়া থাকে, যাহারা সামান্য সূর্য্যোত্তাপে ক্লান্ত হইয়া পড়ে, সেই কোমল প্রাণা ললনাদিগের প্রতি এরূপ অত্যাচার কেমন করিয়া হইয়াছিল, তাহা ভাবিয়া উঠা যায় না। সে সময়ে বিধাতার হস্ত হইতে দেবীসিংহের মস্তকে শত অশনি পতিত হয় নাই কেন, বুঝিতে পারি না। দেবকুলের শাপাগ্নি তৎক্ষণাৎ তাহাকে দগ্ধ করে নাই কেন, জানি না। জগতে এমন প্রাণ কাহার আছে যে, এই সকল কুলললনার প্রতি জ্ঞানাতীত, ভাবাতীত অত্যাচারে কাঁদিয়া না উঠে। ইউরোপীয় মহিলাগণ এই ব্যাপার শ্রবণে মূর্ছিত হইয়া পড়েন।
মহামতি বার্কের অনলবর্ষিণী বক্তৃতা ইউরোপীয় জনসমাজকে স্তম্ভিত করিয়াছিল। কিন্তু হায়! আমরা ভারতবাসী হইয়া সেই দেবীসিংহের কি করিয়াছিলাম? বরং সে সময়ে বাঙ্গলার সকল বড়লোকই তাহার সভায়! এরূপ না হইলে আমাদের দুর্দশার একশেষ হইবে কেন? হার মাতঃ ভারতভূমি! তোমার পুণ্যগর্ভে দেবীসিংহের ক্ষার সন্তানেরও জন্ম হইয়াছিল!! স্ত্রীলোকগণ যখন ঐরূপ অত্যাচার সহ্য করিয়া গৃহে প্রতিনিবৃত্ত হইত, তখন আত্মীয়স্বজনগণ তাহাদিগকে গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিত না। যাহাদের পবিত্রতা নষ্ট হয়, কে তাহাদিগকে গৃহে স্থান দিয়া থাকে?
এইরূপ অবস্থায় তাহারা নিরাশ্রয়া হইয়া’ অনাপার ন্যায় দেশে দেশে ঘুরিয়া বেড়াইত! ব্রাহ্মণদিগের জাতিনাশের এক নূতন উপায় উদ্ভাবিত হইয়াছিল। তাঁহাদিগকে বিচারালয়ের সম্মুখে আনিয়া বলদে আরোহণ করাইয়া, বাস্তধ্বনির সহিত নগর প্রদক্ষিণ করাইতে করাইতে লাঞ্ছনার একশেষ করা হইত! সমস্ত লোক ব্রাহ্মণের এরূপ অপমানদর্শন পাপজনক মনে করিয়া দেশ ছাড়িয়া পলায়ন করিত! সেই সমস্ত ব্রাহ্মণদিগকে তাহা দের স্বজাতিগণ সমাজে গ্রহণ করিতেন না। কাজেই তাঁহাদিগকে জাতি-চ্যুত হইয়া দীনবেশে সময় কাটাইতে হইত।
এইরূপে অপমানের ভয়ে, অনেক ব্রাহ্মণ দেবীসিংহের কঠোর প্রস্তাবে স্বীকৃত হইতেন; যাঁহারা স্বীকৃত না হইতেন, তাঁহারা ঐরূপ শাস্তি ভোগ করিয়া, জাতি হারাইয়া দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হইতেন। এইরূপ দিন দিন শত শত অত্যাচারে দিনাজপুর ও রঙ্গপুর প্রদেশ শয়তানের বাসভূমি হইয়া উঠিল। জমিদার, প্রজা, ধনী, কৃষক, পুরুষ, স্ত্রী সকলেরই প্রতি সমানভাবে অত্যাচারের স্রোতঃ প্রবাহিত হইয়াছিল। শিশু সন্তান ও কুমারীবালিকা পর্যন্ত নিস্তার পায় নাই। ভারতবর্ষে হিন্দুকুলে জন্মগ্রহণ করিয়া, এরূপ পিশাচ প্রকৃতির পরিচয় বোধ হয়, আর কেহ প্রদর্শন করে নাই।