বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে। সামনে দুটি পথ—নির্ধারিত সময়ে এলডিসি তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়া, নাকি আন্তর্জাতিক মহলকে বোঝানো যে আরও কিছু সময় প্রয়োজন। প্রায় পাঁচ দশক এলডিসি মর্যাদার কারণে বাংলাদেশ নানা সুবিধা ভোগ করেছে। কিন্তু এখন সরকার আর সেই “এলডিসি ক্লাব”-এ থাকতে চায় না। নীতিনির্ধারকদের মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণ কেবল মর্যাদার বিষয় নয়, বরং বিশ্বকে দেওয়া একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক বার্তা।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, প্রস্তুতির ঘাটতি থাকলে রফতানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই প্রশ্ন উঠছে—উত্তরণ কি নতুন চ্যালেঞ্জের সূচনা করবে?
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প। এককভাবে এটি বৈদেশিক আয়ের ৮৪ শতাংশ যোগান দেয়। এলডিসি মর্যাদার কারণে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডার মতো বড় বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছে এই খাত। আশঙ্কা হচ্ছে, সুবিধা হারালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশি পোশাক।
ওষুধ শিল্পও ঝুঁকিতে। বর্তমানে ট্রিপস চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ মেধাস্বত্ব আইনের অনেক বাধা থেকে ছাড় পেয়েছে। ফলে বহুজাতিক কোম্পানির ওষুধের জেনেরিক সংস্করণ উৎপাদন ও রফতানি সম্ভব হয়েছে। কিন্তু উত্তরণের পর এ সুবিধা হারালে উৎপাদন খরচ বাড়বে, বাজার সংকুচিত হবে, আর লাখো শ্রমিক কর্মসংস্থান হারাতে পারেন।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও শঙ্কা রয়েছে। কপিরাইট ও বৌদ্ধিক সম্পদের কড়াকড়ি বাড়লে ছোট উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়বেন। এতে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সরকারের অবস্থান
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা করছে উত্তরণ তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন—শুল্ক সুবিধা হারানো, রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা, জ্বালানি সংকট এবং নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তা।
কিন্তু কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও বড়। জাপান ও তুরস্ক প্রায়শই সময় বাড়ানোর অনুরোধে আপত্তি জানায়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রেজুলেশন পাস করতে হলে বড় শক্তিগুলোর সমর্থন দরকার, যা অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, “বাংলাদেশের উচিত চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা গড়ে তোলা। সব সময় যদি ব্যবসায়ীরা বলেন ‘প্রস্তুতি হয়নি’, তবে আমরা কখনোই প্রস্তুত হতে পারব না।”
গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিড জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি পাল্টা শুল্ক আরোপ করে তবে এক বছরে বাংলাদেশের রফতানি প্রায় ১৪ শতাংশ কমতে পারে। প্রতিযোগী দেশগুলোরও প্রভাব পড়বে—চীনের ৫৮ শতাংশ, ভারতের ৪৮ শতাংশ, ভিয়েতনামের ২৮ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার ২৭ শতাংশ রফতানি হ্রাস পেতে পারে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
বিশ্বে উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার নজির রয়েছে। মালদ্বীপ সুনামির কারণে, নেপাল ভূমিকম্পে, মিয়ানমার সামরিক অভ্যুত্থানে এবং অ্যাঙ্গোলা তেলের দামের পতনে সময় পেয়েছিল। সলোমন দ্বীপপুঞ্জও গৃহযুদ্ধের কারণে বিলম্ব করেছিল। তবে এসব ছিল বড় ধরনের দুর্যোগ ও অপ্রত্যাশিত সংকট। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যদি বিলম্ব চাইতে হয়, তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী যৌক্তিকতা হাজির করতে হবে।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির দৃষ্টিভঙ্গি
বিশ্বব্যাংক: সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই উত্তরণের যোগ্য। শুধু প্রস্তুতির ঘাটতি দেখিয়ে বিলম্ব চাওয়া সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক অডিটে প্রমাণ করতে হবে অন্তত দুটি সূচক মানের নিচে নেমেছে, অথবা উত্তরণের পর অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়বে।
আইএমএফ: বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ, কর রাজস্ব বৃদ্ধি এবং আর্থিক খাত সংস্কার না হলে উত্তরণের পর অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।
এডিবি: রফতানি বৈচিত্র্য না আনলে বাজার হারানোর ঝুঁকি প্রবল। শ্রম উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ বাড়াতে না পারলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।
বিরোধিতা ও ভূ-রাজনীতি
বাংলাদেশের বিলম্ব চাওয়া নিয়ে জাপান ও তুরস্ক বারবার আপত্তি জানাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ভারতও পরোক্ষভাবে লাভবান হবে যদি বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা হারায়। তখন ভারতীয় পোশাক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে। একইভাবে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়াও বাজার দখল বাড়াতে চাইবে।
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নেবে। ফলে সর্বসম্মত সমর্থন পাওয়া বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে না।
প্রমাণ হতে পারে জুলাই আন্দোলন ও এক বছরের শাসন
বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ শুধু অর্থনীতির নয়, রাজনৈতিক প্রভাবও বহন করে। এলডিসি মর্যাদা হারালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ নতুন পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে—সরকারের কাছে এটি সাফল্যের প্রতীক হলেও ব্যবসায়ীদের কাছে চাপের প্রতীক।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এই প্রশ্ন রাজনৈতিক বিতর্কেও আসতে পারে। যদি সরকার বিলম্ব চাইতে গিয়ে ব্যর্থ হয়, বিরোধীরা এটিকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখাবে। আর সময় বাড়াতে পারলেও প্রশ্ন থাকবে—বাংলাদেশ আসলেই প্রস্তুত ছিল কি না।
আরও একটি দিক গুরুত্বপূর্ণ—যদি বাংলাদেশ উত্তরণের পথে না গিয়ে এলডিসিতেই থাকতে চায়, তবে তা স্পষ্ট বার্তা দেবে যে জুলাই আন্দোলন ও গত এক বছরের ইউনুস নেতৃত্বাধীন শাসন অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে। এতে আন্তর্জাতিক আস্থা আরও কমে যেতে পারে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
রফতানি খাতের ধাক্কা, বিশেষ করে পোশাক ও ওষুধ শিল্পে।
শুল্ক বৃদ্ধি, গড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত।
বিদেশি বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা।
মেধাস্বত্বের কড়াকড়ি, ওষুধ শিল্পে ব্যয় বৃদ্ধি।
ঋণ সুবিধা সংকোচন, স্বল্পসুদে ঋণ কমে যাওয়া।
প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা—নীতিনির্ধারণ ও কূটনৈতিক প্রস্তুতির ঘাটতি।
আন্তর্জাতিক তুলনামূলক অভিজ্ঞতা
দেশ
বিলম্বের কারণ
সময় বৃদ্ধি
ফলাফল
মালদ্বীপ
২০০৪ সালের সুনামি
৩ বছর
অর্থনীতি পুনর্গঠনের সুযোগ, কিন্তু পর্যটনে দীর্ঘমেয়াদি চাপ
নেপাল
২০১৫ সালের ভূমিকম্প
৩ বছর
অবকাঠামো পুনর্গঠন হলেও বিনিয়োগ ধীর
মিয়ানমার
সামরিক অভ্যুত্থান ও অস্থিরতা
২ বছর
আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা হ্রাস
অ্যাঙ্গোলা
তেলের দামের পতন
৩ বছর
অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনলেও ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে
সলোমন দ্বীপপুঞ্জ
গৃহযুদ্ধ
২ বছর
আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে পুনর্গঠন শুরু
সামনে কী?
অক্টোবর-নভেম্বরে সিডিপি পুনর্মূল্যায়ন হবে। তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে—বাংলাদেশ কি আরও তিন বছর সময় পাবে, নাকি ২০২৬ সালের নভেম্বরে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠবে।
বাংলাদেশ প্রায় পাঁচ দশক এলডিসি মর্যাদার অধীনে আন্তর্জাতিক সুবিধা ভোগ করেছে। এখন প্রশ্ন—প্রস্তুতি ছাড়া ঝুঁকি নিয়ে এগোবে, নাকি আরও কিছু সময় নিয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে।
এই সিদ্ধান্ত কেবল অর্থনীতির নয়; আগামী দশকের রাজনীতি, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থানও নির্ধারণ করবে। আর যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পুনরায় এলডিসিতে ফিরে যেতে চায়, তবে তা হবে অর্থনৈতিক দুর্বলতার প্রতীক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচক বার্তা—যে সাম্প্রতিক আন্দোলন ও শাসন পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি টেকসই ভিত্তি হারিয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















