হাল্লা পর্বতের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা বাগানগুলো ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। একসময় যেখানে কমলার দখল ছিল, এখন সেখানে শোভা পাচ্ছে ভূমধ্যসাগরীয় জলপাই গাছ। রূপালি-সবুজ পাতায় ভরা এসব গাছ জেজুর কৃষিকে নতুন পরিচয় দিচ্ছে, কারণ দ্বীপটি দিন দিন বেশি উষ্ণ ও শুষ্ক হয়ে উঠছে।
জলপাইয়ের জন্য অনুকূল আবহাওয়া
সেপ্টেম্বরে শুরুতেই হালকা সবুজ রঙের জলপাই ঝুলতে দেখা যায় গাছে। এরই মধ্যে কিছু গাঢ় হতে শুরু করেছে। শিগগিরই হবে ফসল তোলা।
সিওম অলিভ ফার্মের মালিক কিম গিল-ইয়ং জলপাই চাষ ও সংরক্ষণে কাজ করছেন। তিনি কোরিয়ায় জলপাই চাষের অগ্রদূতদের একজন। তার মতে, জেজুর আবহাওয়া এখন জলপাই গাছের জন্য বেশি উপযোগী হচ্ছে।
কিম জানান, মে ও জুন মাসে যখন জলপাইয়ের পরাগায়ন হয়, তখন এখনকার মতো শুষ্ক আবহাওয়া জলপাইয়ের জন্য সুবিধাজনক। কারণ জলপাই গাছ কেবল বাতাসের উপরে নির্ভর করে পরাগায়নের জন্য। জেজুর বিখ্যাত বাতাস তাই হয়ে উঠছে প্রাকৃতিক সহায়তা।
তবে এই বছর জেজু রেকর্ড ভাঙা গরম সহ্য করেছে। ট্রপিকাল রাত বেড়েছে। কিমের মতে, চরম গরম ক্ষতি করলেও শুষ্ক বসন্তে পরাগায়নের সুবিধা সেই ক্ষতিকে ছাপিয়ে যায়।

ছোট হলেও বাড়ছে জলপাই চাষ
১৬ বছর আগে সিওগুইপোতে এসে কিম জলপাই চাষ শুরু করেন। তখন কোরিয়ায় এই চাষে তিনিই ছিলেন প্রথম। একই সময়ে দ্বীপের অপর প্রান্তে জুং ইয়ে-ইয়লও শুরু করেন জলপাই ফার্ম, ‘জেজু অলিভ গ্রোভ ২১০’। পরে দুজন মিলে কোরিয়ার জলপাই শিল্পের পথপ্রদর্শক হন।
জুংয়ের ফার্ম এখন দ্বীপের সবচেয়ে বড় জলপাই বাগান, আকারে প্রায় ২৩ হাজার বর্গমিটার। এখানে মূলত তেলের জন্য উপযোগী জাতের জলপাই উৎপাদন হয়। তেল তৈরির জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতিও স্থাপন করা আছে, যদিও উৎপাদন এখনো সীমিত।
তিন বছর আগে তারা গঠন করেন ‘জেজু অলিভ সোসাইটি’, যাতে তথ্য বিনিময় ও জলপাই সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো যায়। বর্তমানে দ্বীপে প্রায় ২৫টি জলপাই ফার্ম আছে বলে কিম জানান। তরুণ কৃষকরা ক্রমেই এই ফসলে আগ্রহী হচ্ছেন।
কিম মনে করেন, কমলা চাষের সমস্যাই অনেক কৃষককে জলপাইয়ের দিকে নিয়ে আসছে। গত বছর তীব্র গরমে অনেক কমলা ফেটে যায়, ফলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখনই অনেক কৃষক বিকল্প ফসল হিসেবে জলপাইয়ের সম্ভাবনা দেখতে পান।

জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বজুড়ে জলপাই
জলপাই মূলত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপসহ উষ্ণ ও শুষ্ক গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় জন্মে। জেজুতে বৃষ্টিপাত বেশি হলেও ঋতুর বিভাজন এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা জলপাইয়ের জন্য উপযোগী আবহাওয়া তৈরি করছে।
ইউরোপে চরম গরমে বড় বড় জলপাই খামার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে কোরিয়ার মতো নতুন জায়গা জলপাইয়ের জন্য সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে।
গ্রামীণ উন্নয়ন প্রশাসন (RDA) ইতিমধ্যে জলপাইসহ ১৭টি উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় ফসলকে কোরিয়ায় চাষযোগ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এর মধ্যে আছে ঢেঁড়স, পেঁপে ও পানিফল।
‘মেড ইন কোরিয়া’ জলপাই তেলের স্বপ্ন
এখনও কোরিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে জলপাই তেল উৎপাদন শুরু হয়নি। জুং গত বছর মাত্র ১০০টি ছোট বোতল তৈরি করতে পেরেছেন, যা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য যথেষ্ট নয়। আপাতত তিনি নিজে ও পরিবারের জন্য ব্যবহার করেন।

তবে সীমিত উৎপাদন হলেও জেজু অলিভ গ্রোভ ২১০-এর এক্সট্রা ভার্জিন তেল ইতিমধ্যেই স্বাদ ও মানের জন্য প্রশংসিত হয়েছে। ২০২৪ সালে তৈরি হওয়া ‘স্পিরিট অব দ্য সান’ লেবেলযুক্ত ব্যাচ কোরিয়া আন্তর্জাতিক অলিভ অয়েল প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পুরস্কার জিতেছে।
তবুও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে আরও বড় জমি, পরিণত গাছ এবং সময়ের প্রয়োজন। সাধারণত জলপাই গাছ ফল দিতে শুরু করে চার থেকে পাঁচ বছরে, আর সর্বোচ্চ উৎপাদনে পৌঁছাতে লাগে প্রায় ২৫ বছর।
জুংয়ের মতে, এত কম উৎপাদনের জন্য বিপণন ও কাগজপত্রের ঝামেলা নেওয়া কঠিন।
জলপাইয়ের ভবিষ্যৎ
কিম আশাবাদী, স্বাস্থ্যগুণের কারণে জলপাই চাষ জেজুতে সফল হবে। ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জলপাইয়ে আছে স্বাস্থ্যকর চর্বি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রদাহনাশক গুণ, যা ক্যানসার, হৃদরোগসহ নানা অসুখ প্রতিরোধে সহায়ক।
‘আমি জেজুতে জলপাইয়ের সম্ভাবনা স্পষ্ট দেখছি,’ বলেন কিম।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















