অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পাঠানো বন্ধ আছে বলে মঙ্গলবার ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান৷
আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী বিষয়ক সেলের প্রধান মো. নাজমুল আবেদীন ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘নানা কারণে ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থী পাঠানো (রিলোকেট) এখন বন্ধ আছে৷ এখন এই ক্যাম্পই বন্ধ করে দেয়া হবে, নাকি রিলোকেট আবার শুরু হবে, কোনো বিষয়েই সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ তবে দুইটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷ নানা পর্যায়ে কথা হচ্ছে৷”
রোহিঙ্গা বিষয়ক কমিশনার মিজানুর রহমান জানান, নতুন করে আবার সেখানে রোহিঙ্গাদের পাঠানো হবে কী না তা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ভাসানচর একটি দ্বীপ৷ ওখানে পরিস্থিতি ভালো থাকার কোনো কারণ নেই৷ প্রথম সমস্যা হচ্ছে যোগাযোগের সমস্যা৷ রোগীদের চিকিৎসা সংকট প্রবল৷ কারণ তাদের নোয়াখালী সদর হাসপাতালে পাঠাতে হয়৷ সেটা খুব কঠিন৷ জ্বালানি সংকট প্রবল৷ মাসে ছয় হাজার এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার লাগে৷ কিন্তু আমাদের হাতে আছে সাড়ে তিন হাজার৷ এগুলো পাঠানো এবং এনজিওদের মাধ্যমে দেয়াও একটা কঠিন কাজ৷ ৫০ শতাংশ ঘাটতি আছে৷”
‘‘সেখানে তাদের সেবা দিতে কক্সবাজারের ক্যাম্পের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়৷ মাথাপিছু ৩০ শতাংশ বেশি খরচ হয়৷ ফান্ড ক্রাইসিস তো আছেই৷ সেটা ভাসানচর, কক্সবাজার সবখানেই,” বলে জানান তিনি৷
মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আরো সমস্যা আছে৷ তারা অবৈধভাবে সমুদ্রে যাচ্ছে৷ অবৈধভাবে কাঁকড়া ধরছে৷ এটা নিয়ে মৎস্য বিভাগের আপত্তি আছে৷ আবার সাগরে নোয়াখালীর জেলেদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রায়ই সংঘাত হয়৷”
তিনি জানান, ‘‘সুযোগ পেলেই রোহিঙ্গারা ভাসানচর থেকে পালিয়ে যান৷ এখন পর্যন্ত সাত হাজার জন পালিয়ে গেছেন৷ তাদের নতুন ঠিকানা চিহ্নিত করার কাজ চলছে৷ আসলে রোহিঙ্গারা ভাসানচরে থাকতে চান না৷ আর তাদের সেখানে রাখাও বেশ ঝামেলার৷ সরকারের একটা প্রজেক্ট ছিলো ‘গো এন্ড ফ্রি ভিজিট’ নামের৷ এই প্রজেক্টের আওতায় তারা কক্সবাজারে গিয়ে আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করে আবার ফিরে আসতে পারতেন৷ কিন্তু এই প্রজেক্টে কোনো ফান্ড নেই অনেক দিন ধরে৷ ফলে ভাসানচরের রোহিঙ্গারা এখন আর ভাসানচরের বাইরে যেতে পারেন না৷”

ভাসানচরের রোহিঙ্গারা যা বলছেন
শুরুর দিকেই কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে গিয়েছেন এরকম দুইজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে ডিডাব্লিউ৷ তাদের একজন কেফায়েত উল্লাহ৷ তিনি প্রায় চার বছর ধরে এই ক্যাম্পে আছেন৷ তার চার ছেলে-মেয়ে৷ তিনি ওয়াশ ভলান্টিয়ার হিসাবে চাকরিও করছেন৷ এখানে আসার আগে তিনি কক্সবাজারের শ্যামলপুর ক্যাম্পে থাকতেন৷
কেফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘‘আট মাস আগে কক্সবাজার ক্যাম্পে আমার মা মারা যান৷ আমি মায়ের লাশ দেখার জন্য কক্সবাজার যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম৷ কিন্তু যেতে পারিনি৷ আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়নি৷”
‘‘আর এখানে এখন আমার মেয়েটির পড়ার সুযোগ নেই৷ সে নবম শ্রেণিতে উঠৈছে৷ কিন্তু এখানকার যে স্কুল তাতে ওই শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ নেই৷ রান্নার গ্যাস (সিলিন্ডারের এলপিজি) ঠিকমতো পাওয়া যায় না৷ ফলে সবসময় রান্নাও হয় না৷ আর চিকিৎসাকেন্দ্র তেমন ভালো নয়৷ প্রথম দিকে যে খাবার দেয়া হতো তার চেয়ে এখন খারাপ অবস্থা,” বলে জানান তিনি৷
এক প্রশ্নের জবাবে কেফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘‘আমি এখানে থাকতে চাই না৷ কক্সবাজারের ক্যাম্পে চলে যেতে চাই৷ কিন্তু সেটা কাউকে এখনো বলিনি৷ কাকে বলব বুঝতে পারছি না৷”
ভাসানচরের আরেকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীসায়েদ আলমও প্রায় চার বছর আগেই কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে যান৷ স্ত্রী ও তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে তার পাঁচজনের পরিবার৷ ভাসানচরে একটি এনজিওর ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করছেন৷
সায়েদ আলম বলেন, ‘‘প্রথমদিকে যেভাবে রেশন দেয়া হতো এখন আর সেরকম দেয়া হয় না৷ ফলে খাবারের সমস্যা৷ খাবার পানি আছে, পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট দিয়ে খেতে হয়৷”
‘‘আমার তো এখানে চাকরি আছে ফলে আমার তেমন সমস্যা নেই৷ তবে অনেকেই সমসায় আছেন৷ আর আমরা চাইলেও এখন ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারি না৷ আমার সবাই এখানে, ফলে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না৷ তবে অনেকের আত্মীয়স্বজন কক্সবাজারে আছেন৷ তাদের সমস্যা হচ্ছে,” বলে জানান তিনি৷
এক প্রশ্নের জবাবে সায়েদ আলম বলেন, ‘‘আমার সবাই এখানেই আছে৷ সেই দিক দিয়ে আমি ভালো আছি৷ এখানেই থাকতে চাই৷ তবে কেউ কেউ এখানে থাকতে চান না৷ কক্সবাজারে ফিরে যেতে চান৷”

‘একটি গোষ্ঠী বা বাহিনীকে লাভবান করতে প্রকল্প’
রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক রেজাউর রহমান লেনিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুরুতেই আমরা ভাসানচরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প করার বিরোধিতা করেছিলাম৷ আসলে ওটা একটা কারাগারের মতো৷ যাদের ওখানে নেয়া হয়েছে তাদের কাউকে ভুল বুঝিয়ে আবার কাউকে জোর করে নেয়া হয়েছে৷ সরকার যতই বলুক স্বেচ্ছায় তার গিয়েছে, তা ঠিক নয়৷”
তিনি বলেন, ‘‘ওই জনমানবহীন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে শরণার্থী ক্যাম্পকরার কোনো যুক্তি ছিলো না৷ তারা অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হন৷ আসলে কোনো একটি গোষ্ঠী বা বাহিনীকে আর্থিকভাবে লাভবান করতে সরকারের বিশাল পরিমাণ টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে৷ তাতে ওই গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে৷”
‘‘আমার মনে হয় এখন ভাসানচর ক্যাম্প বন্ধ করে দিয়ে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা উচিত৷ কিন্তু তাতেও নতুন করে পরিকল্পনা লাগবে৷ তাদের কোথায় আশ্রয় দেয়া হবে তার পরিকল্পনা লাগবে,” বলেন তিনি৷
ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে লেনিন বলেন, ‘‘সাত হাজার পালিয়ে গেছেন বলে বলা হচ্ছে৷ কিন্তু এটা ঠিক নয়৷ তাদের অনেকেই কারাগারে আছেন৷”

ভাসানচরে কাজ করা এনজিও কর্মকর্তার বক্তব্য
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সেবাদানকারী এনজিওগুলোর একটির প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ভাসানচর একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প, যদিও সরকার ও ইউএন সেটা প্রকাশ্যে বলে না৷ ইউএন-এর কোনো টিম যদি ভাসানচরে যায় তাহলে সেটাকে তারা ইউএন মিশন হিসাবে দেখে৷ বাইরে ইউএন মিশনের জন্য যেরকম খরচ হয় তাদের জন্যও একই খরচ ও ব্যবস্থাপনা রাখতে হয়৷”
‘‘আর ওখানে পুলিশ ও কোস্ট গার্ড নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভাসানচর থেকেরোহিঙ্গারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়৷ তারা ওখানে আসলে থাকতে চান না৷ কারণ কক্সবাজার থেকে যারা ভাসানচরে গিয়েছেন তারা বেশি সুযোগ সুবিধা পাবে ভেবেছিলেন, কিন্তু তারা সেই হিসাবে কম সুবিধা পাচ্ছেন৷ আর তাদের বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে হয়৷”
ঐ এনজিও কর্মকর্তা বলেন, ‘‘এখনতো সেখানে গ্যাস সিলিন্ডারেরও সংকট চলছে৷ আরো অনেক সংকট আছে৷ তারমধ্যে যোগাযোগ একটি বড় সংকট৷ ফলে এই ক্যাম্পটি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে৷”
ভাসানচরের কথা
ভাসানচর ক্যাম্পটি নোয়াখালী জেলার অধীনে৷ সেখানে যেতে হলে চট্টগ্রাম হয়ে সমুদ্রপথে যেতে হয়৷ বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় পড়েছে দ্বীপটি৷
৪০ বর্গকিলোমিটার দ্বীপটিতে ১২০টি গুচ্ছ গ্রাম তৈরি করেছে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার৷ প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে৷ প্রকল্পে বানানো ঘরগুলো মাটির চার ফুট ওপরে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে৷ পুরো প্রকল্পটি ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা সুরক্ষা বাঁধের ভেতরে৷ এছাড়াও সেখানে আছে ১২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র- যা স্কুল, মেডিকেল সেন্টার এবং কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷
ভাসানচর ক্যাম্পের দায়িত্বে নিয়োজিত অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহফুজার রহমান জানান, ‘‘এখন ৩৭ হাজারের বেশি শরণার্থী এই ক্যাম্পে অবস্থান করছেন৷ তাদের মধ্যে যারা এখান থেকে চলে গেছেন তাদের নতুন ঠিকানা নির্ধারণের চেষ্টা করা হচ্ছে৷”
তিনি জানান, ‘‘ক্যাম্পে সরকারের দিক থেকে ৬০০-এর বেশি লোক সেবা দিচ্ছে৷ ২২টি এনজিও এবং পাঁচটি ইউএন এজেন্সি মিলে আরো সাড়ে ৬০০ লোক সেবা দিচ্ছেন৷রোহিঙ্গাদের জন্য স্কুল, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র আছে৷ ভিতরে রোহিঙ্গাদের চলাচলের জন্য ৭০০ রিকশা ভ্যান আছে, যেগুলো রোহিঙ্গারাই চালান৷”
DW – 23.09.2025