ম্যানহাটনের উপকূলে তিমির আবির্ভাব
আগস্টের শুরুতে আমেরিকান প্রিন্সেস ক্রুজ জাহাজে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীরা অপেক্ষা করছিলেন এক দৃশ্যের জন্য। হঠাৎই এক কিশোর হাম্পব্যাক তিমি, যাকে ‘এনওয়াইসি০৩১৮’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে, পানির ওপর ভেসে উঠে এক লহমায় হাজারো ছোট মাছ গিলে ফেলে।
এই দৃশ্য সমুদ্রের গভীরে নয়, বরং ম্যানহাটনের ঠিক উপকূলেই হওয়ায় যাত্রীরা দারুণ উত্তেজিত হন। গথাম হোয়েল নামের স্বেচ্ছাসেবী গবেষণা সংস্থার যোগাযোগ পরিচালক ক্রিস সেন্ট লরেন্সও উপস্থিত ছিলেন। তিনি শুধু পর্যবেক্ষণই করছিলেন না, তিমির সম্ভাব্য বিপদও নজরে রাখছিলেন। তাঁর মতে, “তিমিরা খাবারের সময় এতটাই মনোযোগী হয় যে নৌকাকে একেবারেই তোয়াক্কা করে না।”
দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে তিমির সংখ্যা
২০১২ সালে গথাম হোয়েল যখন হাম্পব্যাক ট্র্যাক করা শুরু করে, তখন তাদের ক্যাটালগে ছিল মাত্র পাঁচটি তিমি। এখন সেখানে ৪৭০টির বেশি তিমি নিবন্ধিত, বেশিরভাগই অস্থায়ীভাবে আসা তরুণ তিমি। সমৃদ্ধ খাদ্যের টানে তারা নিউইয়র্ক উপকূলে ভিড় করছে।
কিন্তু এই ভিড় তিমিদের বিপদেও ফেলছে। নিউইয়র্ক বাইট অঞ্চলে (দক্ষিণ নিউ জার্সি থেকে পূর্ব লং আইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা) হাম্পব্যাকরা এখন নিয়মিত খাবারের সন্ধান করছে। আর এই একই জলপথ দিয়ে প্রতিদিনই যাচ্ছে কার্গো জাহাজ, ট্যাঙ্কার, ক্রুজ শিপ, মাছ ধরা ট্রলার ও বিনোদনমূলক নৌকা।
বিপদের মূল কারণ
লং আইল্যান্ডের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, কয়েকটি বিষয় একসঙ্গে বিপদ বাড়াচ্ছে—
- হাম্পব্যাক তিমির সংখ্যা পুনরুদ্ধার হওয়া
- জলবায়ু পরিবর্তনে খাদ্যের অবস্থানের পরিবর্তন
- তিমিদের খাবারের খোঁজে সরাসরি জাহাজ চলাচলের পথে চলে আসা
বাণিজ্যিক তিমি শিকার বন্ধ হওয়ার পর থেকে হাম্পব্যাককে সংরক্ষণে বড় সাফল্য এসেছে। ২০১৬ সালে নোয়া (জাতীয় মহাসাগরীয় ও বায়ুমণ্ডলীয় প্রশাসন) নিউইয়র্কের জলে হাম্পব্যাককে বিপন্ন প্রজাতির তালিকা থেকে বাদ দেয়। কিন্তু সেই একই বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে বড় তিমির অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুর ঘটনা বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালে নোয়া একে “অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা” ঘোষণা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নৌযানের ধাক্কা প্রধান কারণ, যদিও মাছ ধরার জালে জড়িয়ে পড়াও ভূমিকা রাখছে।
বিপন্ন প্রজাতির ঝুঁকি
নিউইয়র্ক বাইট কেবল হাম্পব্যাক নয়, আরও নানা তিমির আবাসস্থল। এখানে নীল, ফিন, সি ও স্পার্ম তিমি এবং চরমভাবে বিপন্ন নর্থ আটলান্টিক রাইট তিমিও পাওয়া যায়। ২০২৪ সালের মে মাসে এক ক্রুজ জাহাজ নিউইয়র্ক বন্দরে পৌঁছায়, আর তার সামনের অংশে আটকে ছিল এক মৃত বিপন্ন সি তিমি।
গবেষক থর্নের মতে, “আমরা প্রায় একচেটিয়াভাবে কিশোর তিমিদের ১৫ ফুট গভীরতার অগভীর জলে খাবার খুঁজতে দেখি। এভাবে ভেসে খাওয়া এবং অগভীর জলে থাকা তাদের জাহাজের ধাক্কায় আহত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।”
গথাম হোয়েলের নথিতে রয়েছে এমন তিমির ছবি, যাদের শরীরে জাহাজের প্রপেলারের গভীর ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে দ্রুত উষ্ণ হওয়া এই অঞ্চলের কারণে তিমিরা খাদ্যের জন্য আরও বেশি উপকূলে চলে আসছে।
সমাধানের পথ ও রাজনৈতিক বাধা
সমাধান হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাহাজের গতি কমানো বা পথ পরিবর্তন করা দরকার। কিন্তু নিউইয়র্কে প্রবেশের জন্য তিনটি বড় শিপিং লেন থাকায় পথ পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব।
গবেষণায় দেখা গেছে, জাহাজের গতি ১০ নটস (প্রায় ১২ মাইল/ঘণ্টা) নামিয়ে আনা গেলে ধাক্কার ঝুঁকি ও ক্ষতি অনেকটা কমে। বর্তমানে ২০ মিটার বা তার বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজকে জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত নির্দিষ্ট এলাকায় ১০ নটস গতিসীমায় চলতে হয়। তবে এ বছরের শুরুতে নোয়া এই নিয়ম আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা প্রত্যাহার করে নেয়।
জো বাইডেন প্রশাসনের সময় নোয়ার সহকারী প্রশাসক জ্যানেট কয়েট বলেন, নাবিক ও আইনপ্রণেতাদের বিরোধিতার কারণে এই পরিকল্পনা আটকে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসে ফেরার পর নোয়ার তহবিল, জনবল ও জলবায়ু গবেষণা কর্মসূচিতেও বড় কাটছাঁট হয়।
সংরক্ষণ নৈতিকতার প্রশ্ন
জ্যানেট কয়েট স্মরণ করিয়ে দেন যে ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র যখন বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন চালু করেছিল, তখন সংরক্ষণে একধরনের নৈতিক দায়বদ্ধতা কাজ করত। এখন সেটি আর তেমন নেই বলে তাঁর আশঙ্কা। তিনি বলেন, “মানুষ যদি সত্যিই তিমিকে রক্ষা করতে চায়, তবে তাদের নিজেদের আচরণ বদলাতে হবে।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 





















