বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক অদ্ভুত রঙ্গমঞ্চ, যেখানে প্রতিদিনই অভিনীত হচ্ছে নতুন সব নাটক। একসময় এই নাটকের প্রধান উপকরণ ছিল পোস্টার, ব্যানার, স্লোগান আর লংমার্চ। কিন্তু সময় বদলেছে- প্রতিবাদের অভিধানেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। রান্নাঘরের ডিম আর পায়ের জুতা এখন রাজনীতির নতুন ভাষা, প্রতিবাদের তাজা প্রতীক, এমনকি এক প্রকার “লোকসাহিত্য” হয়ে উঠেছে। বাইরে থেকে দেখলে বিষয়টা হাস্যকর মনে হতে পারে- আরে, এও কি প্রতিবাদের উপায়? কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, ডিম-জুতা নিক্ষেপ আসলে নিছক মজা নয়; বরং গভীর রাজনৈতিক হতাশা, ক্ষোভ আর ব্যঙ্গের বহিঃপ্রকাশ। ফরাসিদের বলা হয় রোমান্টিক, জাপানিদের বলা হয় শৃঙ্খলাবদ্ধ, আমেরিকানদের বলা হয় সাহসী। আর বাংলাদেশের পরিচয় যেন হয়ে উঠছে—“ওরা প্রতিবাদ করে ডিম ছুঁড়ে, জুতা দেখিয়ে।” বহির্বিশ্ব মানুষ প্রথমে ভেবেছিল- বাঙালি জাতির হয়তো কোনো নতুন উৎসব এটি। ডিম ছোঁড়াছুড়িতে ওরাও বেশ মজা পেয়েছে। লন্ডনের বেগমপাড়া, নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস বা সিডনির লাকেম্বায় যখন মন্ত্রীদের দিকে উড়ে গেল ডিম, বিদেশিরা হাসতে হাসতে বলল-“আরে! এ তো নতুন কার্নিভাল।” কিন্তু পরে তারা বুঝল এ কোনো উৎসব নয়, এ এক জাতির গভীর ক্ষোভের ব্যঙ্গচিত্র। যেভাবে একসময় পাট ছিল আমাদের গর্বের প্রতীক, ঠিক সেভাবেই এখন ডিম আর জুতা হয়ে উঠছে আমাদের রাজনৈতিক ব্র্যান্ড। পার্থক্য শুধু—পাট বিক্রি করে আসত বৈদেশিক মুদ্রা, আর ডিম ছুঁড়ে আসে আন্তর্জাতিক হাসাহাসি আর ইউটিউবের ভাইরাল ভিডিও। আমরা যতই গর্ব করি রবীন্দ্রসঙ্গীত, লালন, বাউল, জামদানী, মসলীন বা পাটের ঐতিহ্য নিয়ে-তবু আজকের বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত সাংস্কৃতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে এই ডিম-জুতা। তাহলে কি আমরা সত্যিই প্রবেশ করেছি এক নতুন যুগে- যেখানে কবিতা বা সংগীত নয়, জাতির পরিচয় গড়ে দিচ্ছে ডিমের ছিটে আর জুতার ঝাঁপটা? এ প্রশ্নই আজ আমাদের ভাবাচ্ছে।
বাংলাদেশে রাজনীতির সরলীকৃত ট্রেডিশন ছিল। এখন আর নেই। রাজনীতি জটিল হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা লোভে জড়াচ্ছে। বিগত সরকারের সময় এর পারদের ব্যারমিটার সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে যায়। বাংলাদেশে রাজনীতি আর ভদ্রলোকের খেলা নয়। এখন মাঠে নেমেছে “ডিমওয়ালা বাহিনী” ও “জুতা-ধারীরা।” সংসদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীতিগত আলোচনা করার চেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় ডিম বা জুতা নিক্ষেপ করা অনেক কার্যকর। বাজেট ঘাটতি, ব্যাংক লুট, জলবায়ু সংকট—সব জটিল বিষয় সরল হয়ে গেছে। ডিমই হলো চূড়ান্ত যুক্তি, জুতা হলো শেষ কথা। এই ধারার রাজনীতি সরল, দ্রুত, এবং জনগণের স্রোতকে তার মূল বক্তব্যে পৌঁছে দেয়। গণতান্ত্রিক আলোচনার জায়গায় এসেছে তাৎক্ষণিক নিক্ষেপের নতুন ট্রেডিশন। এই নতুন ধারার রাজনীতি সরল, দ্রুত, এবং আক্রমণাত্মক হলেও স্রোতের অনুভূতি ও রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেয় নিখুঁতভাবে। গণতান্ত্রিক আলোচনার জটিলতাকে এরা প্রতিস্থাপন করেছে তাৎক্ষণিক নিক্ষেপের নতুন ট্রেডিশন দিয়ে—যেখানে প্রতিটি ডিম ও জুতা কেবলই প্রতিবাদ নয়, বরং জনগণের ক্ষোভ, প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক প্রভাব প্রদর্শনের সর্বশেষ মাধ্যম। এক কথায়, এটি এমন এক নতুন রাজনৈতিক ভঙ্গি, যেখানে সংলাপ নয়, সরাসরি ক্রিয়ার মাধ্যমে বার্তা পৌঁছে যায় জনগণের মুখ থেকে সরকারের কাছে।

এদেশের রাজনীতি আজ যেন এক অনন্য রঙিন মঞ্চ, যেখানে প্রতিদিনই অভিনীত হচ্ছে নতুন নাটক, নতুন চরিত্র, নতুন সংঘাত-সংঘর্ষ, আর কখনো কখনো এমন নাটক, যা দর্শকের চোখকে বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয়। একসময় এই নাটকের ভাষা ছিল ব্যানার, স্লোগান, মাইক, দীর্ঘ মিছিল এবং অনশন-এগুলোই ছিল রাজনৈতিক চেতনাকে প্রকাশ করার প্রধান উপায়। মানুষ রাস্তায় নামত, গলায় স্লোগান, হাতে ব্যানার, আর মনে কোনো রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছানোর আশা নিয়ে। কিন্তু আজকের প্রজন্ম সেই ভাষাকে প্রাচীন মনে করছে, মনে করছে এটি পুরনো ও অপ্রয়োজনীয়। আজকের রাজপথের নতুন ভাষা হলো ডিম আর জুতা-যা কেবল প্রতিবাদের হাতিয়ার নয়, বরং এক প্রকার রাজনৈতিক শিল্প ও সামাজিক পারফরম্যান্স। যুক্তি-তর্ক, বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক আলোচনার দিনগুলো বিলুপ্ত। সংসদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীতিগত আলোচনা, মিডিয়ার লাইভ কভারেজ, টকশোতে বিতর্ক-সব কিছু যেন অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রাসঙ্গিক। এখন এক ঝটকায় ডিম উড়ে যায়, অথবা জুতা ছুটে আসে-এটাই জনগণের ক্ষোভের সর্বশেষ প্রকাশ, যা কখনো সরাসরি এবং কখনো ব্যঙ্গাত্মক রূপে ব্যক্ত হয়। এটি শুধু ক্ষোভ নয়; এটি এক ধরনের সামাজিক বার্তা, যা সব স্তরের মানুষকে একই রঙে একত্রিত করে। ছোট শিশুরা, তরুণরা, প্রৌঢ়রা-সবাই রাজপথে এসে দেখছে, যে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতীক কখনো কখনো হয় ডিমের ছিটে আর জুতার ঝাপ। এটি একটি অদ্ভুত হলেও অত্যন্ত শক্তিশালী প্রজেকশন-যেখানে ব্যক্তি সরাসরি সরকারের বা নেতার উপর তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের নাম যখন উঠে, তখন বিদেশিরা হাস্যরসের সঙ্গে বলে-“ওরা এমন দেশ, যেখানে প্রতিবাদের প্রথম অস্ত্র হলো ডিম, শেষ কথা হলো জুতা।” এটি কেবল ব্যঙ্গ নয়; এটি আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচায়ক। আজ বাংলাদেশি প্রতিবাদের দৃশ্য ইউটিউব, টিকটক এবং সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ভাইরাল হচ্ছে। বিশ্বে প্রতিটি দেশের একটি ছাপ থাকে। ফরাসি রোমান্টিক, জাপানি শৃঙ্খলাবদ্ধ, আমেরিকান সাহসী। বাংলাদেশের পরিচয় এখন দাঁড়িয়েছে-“ওরা প্রতিবাদ করে ডিম ছুঁড়ে, জুতা নিক্ষেপ করে।” জাতিসংঘে পতাকার পাশে প্রতীক বসানো হলে হয়তো দেখা যাবে এক ঝুড়ি ডিম আর একজোড়া জুতা। শিশুদের পাঠ্যবইয়ে লেখা হবে-“ডিম ছোড়া ও জুতা প্রদর্শন বাংলাদেশের অমূল্য সাংস্কৃতিক পরিচয়।” একদিকে যেমন লজ্জা, অন্যদিকে ব্যঙ্গাত্মক গর্ব—এটাই আমাদের নতুন জাতিগত ব্র্যান্ডিং। এতে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের জাতীয় ভাবমূর্তি এখন শুধু ঐতিহ্য, সাহিত্য বা সংগীতের মাধ্যমে নয়, বরং প্রতিবাদের সরাসরি ক্রিয়া-কৌশলের মাধ্যমে গড়ে উঠছে। এ লজ্জার বোধের কথা যদি হাস-মুরগি জানতো হয়তো তারা ডিম পাড়া বন্ধই করে দিত।

প্রবাসীরা আমাদের গর্ব। দেশের জন্য তাঁদের অবদান অনেক। কতক প্রবাসীর কারণে প্রবাসীদের অবদান এখন ডিমট্যান্স ও নিক্ষেপ রেমিট্যান্স অর্থাৎ ডিমট্যান্সে চলে এসেছে। প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রদূত-তারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে পরিবারের জীবিকা নিশ্চিত করেন, দেশের মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলা করে, এবং বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী রাখেন। কিন্তু আজকাল তাদের অবদান শুধু আর্থিক নয়; তারা একটি নতুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকও তৈরি করেছেন—যাকে অনেকে নাম দিয়েছেন “ডিমট্যান্স।” যখনই কোনো মন্ত্রী, এমপি বা রাজনৈতিক নেতা বিদেশে যান, প্রবাসীরা হাতে ডিম নিয়ে উপস্থিত হন। এটা বহু দিনের চর্চা। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, লন্ডনের বেগমপাড়া, টরন্টোর মিলিটারি রোড—যেখানে যাই না কেন, ডিম নিক্ষেপ হয়। এটি শুধু নিক্ষেপ নয়; এটি এক প্রকার আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ, যা রাজনৈতিক ব্যঙ্গ, সামাজিক অসন্তোষ এবং নাগরিক শক্তির এক অনন্য সমন্বয়।
বিদেশিরা প্রথমে হতবাক হয়। কেউ ভাবেন এটি হয়তো কোনো আধ্যাত্মিক রিচ্যুয়াল-যেখানে নেতাকে শুদ্ধ করা হয়, রাজনৈতিক অপরাধ মাফ করার চর্চা হয়। কেউ মনে করে-এটি একটি নতুন ধরনের পারফরম্যান্স আর্ট, যেখানে জনগণ সরাসরি নায়ক ও প্রতিপক্ষের দিকে তাদের ক্ষোভের শিল্পীভাবে প্রকাশ করছে। ইউটিউব, টিকটক এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে এই “ডিমট্যান্স” দ্রুত ভাইরাল হয়। এক ঝলকে ছবি, ভিডিও, হ্যাশট্যাগ আন্তর্জাতিক মানচিত্রে চলে যায়, যা শুধু মজার নয়—এক প্রকার সামাজিক শক্তি ও রাজনৈতিক বার্তা বহন করে।
ডিম-জুতা শুধু প্রতিবাদের মাধ্যম নয়; এটি হয়ে উঠছে জাতীয় ব্র্যান্ড। গর্ব না গ্লানি? পাটের পর এটিই সবচেয়ে আলোচিত “রপ্তানি পণ্য।” বৈদেশিক মুদ্রা আসে না কেবল, আসে আন্তর্জাতিক হাস্যরসও। প্রশ্ন হলো-আমরা কি এই “ডিমতন্ত্র” থেকে বের হতে পারব, নাকি একদিন ইউনেস্কো ঘোষণা করবে—“ডিম-জুতা নিক্ষেপ বাংলাদেশের অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য”?
প্রবাসীরা রেমিট্যান্সের সঙ্গে যুক্ত করেছে নতুন অবদান। এই নতুন অবদান শুধু দেশের অর্থনীতি নয়, দেশের রাজনৈতিক পরিচয়কেও শক্তিশালী করছে। “ডিমট্যান্স” দেখাচ্ছে, বাংলাদেশিরা আর সীমাবদ্ধ নন; তারা প্রবাসী হোক বা দেশপ্রেমিক, নিজেদের ক্ষোভ, ব্যঙ্গ এবং রাজনৈতিক দাবিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরতে সক্ষম। এটি পরিণত হয়েছে একটি সাংস্কৃতিক ব্র্যান্ড, যা বিদেশির চোখে বাংলাদেশকে এক অদ্ভুত, হাস্যরসাত্মক, কিন্তু প্রগাঢ় রাজনৈতিক জাতি হিসেবে পরিচিত করছে। অতএব, প্রবাসীরা শুধুই অর্থ পাঠাচ্ছেন না; তারা হাতে ডিম এবং মনোযোগ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন ভঙ্গি ও সামাজিক শক্তিকে আন্তর্জাতিকভাবে দৃঢ় করে তুলছেন। রেমিট্যান্স আর ডিমট্যান্স—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অনন্য সংমিশ্রণ, যা দেখাচ্ছে, নাগরিক শক্তি আর রাজনৈতিক ব্যঙ্গ এখন আর কোনো দেশের সীমাবদ্ধতা মানে না।

যেভাবে একসময় পাট বাংলাদেশের জাতীয় অহংকারের প্রতীক ছিল-বাজারে বিক্রি, রফতানি, অর্থনৈতিক গুরুত্ব-ঠিক তেমনি আজ ডিম আর জুতা ছোঁড়া হয়ে উঠছে নতুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্র্যান্ড। পার্থক্য স্পষ্ট-পাট বিক্রি করলেই বৈদেশিক মুদ্রা আসে, দেশের অর্থনীতি সচল হয়, আর ডিম বা জুতা ছুঁড়লেই আসে ইউটিউবের ভাইরাল ভিডিও, টিকটকের লাখো ভিউ, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের আলোচনা এবং বিশ্বের চোখে হাস্যরস। এটি এক প্রকার ‘ডিজিটাল অর্থনৈতিক আঘাত’-যেখানে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে ধাক্কা দেওয়া হয়, কিন্তু মুদ্রার পরিবর্তে আসে রাজনৈতিক বার্তা ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া।
ডিম-জুতা আন্দোলন শুধু কোন রাজনৈতিক দল কিংবা সরকারের প্রতি ক্ষোভ নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি নতুন ধরণের সামাজিক নাট্যশালায় রূপ দিয়েছে। এখানে নাগরিকরা সরাসরি অংশগ্রহণ করছে, তাদের হাতের ডিম বা জুতা হয়ে উঠছে এক শক্তিশালী ভাষা, যা কথার চেয়ে দ্রুত, বিশ্লেষণের চেয়ে সরাসরি, এবং রাজনৈতিক আলোচনার চেয়ে প্রভাবশালী। এই সরল কিন্তু শক্তিশালী মাধ্যম জনগণকে আত্মবিশ্বাস দিচ্ছে যে, তাদের ক্ষোভ অবহেলা করা যায় না; তারা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, ব্যঙ্গ করতে পারে, এবং এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের বক্তব্য পৌঁছাতে পারে। ডিম-জুতা আন্দোলন তাই হাস্যরসের বাইরে; এটি এক ধরনের আন্তর্জাতিক নজরদারি, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ এবং সামাজিক শক্তির সমন্বয়। এটি দেখাচ্ছে যে বাংলাদেশের রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতা-সংগ্রাম নয়; এটি এক নতুন ধাঁচের নাগরিক শক্তি, যেখানে জনগণ সরাসরি, সৃজনশীলভাবে এবং প্রায়শই ব্যঙ্গাত্মকভাবে অংশ নিচ্ছে। আর এই অংশগ্রহণই ডিম-জুতা আন্দোলনকে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সামাজিক সংস্কৃতির অন্যতম অমূল্য নতুন চিহ্নে পরিণত করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিমের ভাইরাল শক্তি অনেক। আজকের বিশ্বে প্রতিবাদের সাফল্য আর মাপা হয় না শুধু রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি বা ভিড়ের সংখ্যার মাধ্যমে। প্রতিটি মুহূর্ত এখন মিডিয়ার লেন্সের আওতায়-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই প্রতিবাদের প্রভাব এবং ক্ষমতা যাচাই করা হয়। লাইক, কমেন্ট, শেয়ার, ভিউ—এই সংখ্যাগুলোই হয়ে গেছে এক ধরনের “রাজনৈতিক মুদ্রা।” আর বাংলাদেশে ডিম-জুতা আন্দোলন এই নতুন বাস্তবতাকে নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত করছে। একটি ডিম যদি সঠিক সময়ে সঠিক নেতার দিকে ছুটে যায়, তা কেবল রাজনৈতিক ক্ষোভের প্রকাশ নয়; তা হয়ে যায় আন্তর্জাতিক মিডিয়া, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম—সব জায়গায় ভাইরাল ভিডিও। অর্থ উপার্জনের উৎস। প্রতিটি নিক্ষেপ মুহূর্তেই লাখো মানুষ সেটি দেখে, কমেন্ট করে, হাসে, শেয়ার করে এবং সমালোচনা করে। জুতা ছোড়া একইভাবে লক্ষাধিক ভিউ এনে দেয়, যা শুধু বিনোদন নয়, এক প্রকার রাজনৈতিক বার্তাও বহন করে। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শক্তি তৈরি করেছে এক নতুন সংস্কৃতি-যেখানে প্রতিবাদের জনপ্রিয়তা আর প্রভাব নির্ধারণ হয় স্ক্রিনের আলোয়। ভবিষ্যতে হয়তো বাংলাদেশে “বর্ষসেরা ডিম নিক্ষেপকারী” বা “সেরা জুতা ছোড়া” নামে পুরস্কার অনুষ্ঠানও শুরু হবে। রাজনীতিবিদরা লাল কার্পেটে হাঁটবেন, ফ্ল্যাশ লাইট ঝলমল করবে, আর পেছনে একটি বড় স্ক্রিনে চলবে-“এই মঞ্চেই ঘটেছিল ইতিহাসের সেরা ডিম ও জুতা নিক্ষেপ।” এইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরি করছে ডিম-জুতার নতুন ভাইরাল ভবিষ্যৎ। প্রতিবাদের ধারাটিকে স্থায়ী, দৃশ্যমান এবং আন্তর্জাতিক মানচিত্রে পৌঁছে দিচ্ছে।

ভাবুন তো! ফরাসিদের বলা হয় রোমান্টিক, জাপানিদের শৃঙ্খলাবদ্ধ, আমেরিকানদের সাহসী। আর বাংলাদেশের পরিচয় কী?-“ওরা প্রতিবাদ করে ডিম ছুঁড়ে, জুতা নিক্ষেপ করে।” জাতিসংঘে যদি পতাকার পাশে প্রতীক বসাতে হয়, তবে হয়তো দেখা যাবে এক ঝুড়ি ডিম আর একজোড়া জুতা—যেন এটাই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য! তাহলে প্রশ্ন হলো- এ কি জাতির নতুন গর্ব, নাকি আসলেই এক ভয়ঙ্কর গ্লানি? আমরা কি নতুন কোনো ইতিহাস লিখছি, নাকি আসলে নিজেদেরই হাসির খোরাক বানাচ্ছি গোটা দুনিয়ার চোখে?
বিশ্বে প্রতিটি জাতির একটা করে ভাবমূর্তি থাকে। ফরাসিদের বলা হয় রোমান্টিক, জাপানিদের বলা হয় শৃঙ্খলাবদ্ধ, আমেরিকানদের বলা হয় সাহসী। এবার যখন বাংলাদেশের নাম ওঠে, তখন বিদেশিরা হাসতে হাসতে বলে-“ওরা সেই জাতি, যাদের হাতে সবসময় ডিম থাকে।” ভাবুন তো! জাতিসংঘে যদি আমাদের পতাকার পাশে প্রতীকী চিহ্ন রাখতে হয়, তবে সেখানে হয়তো রাখা হবে একটি মুরগির খোপ, তার ভেতরে টগবগে এক ডিম। জুতাকেও তখন দেওয়া হবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা। শিশুদের পাঠ্যবইয়ে লেখা হবে—“ডিম ছোড়া ও জুতা প্রদর্শন বাংলাদেশের অমূল্য সাংস্কৃতিক পরিচয়।” একদিকে যেমন লজ্জা, অন্যদিকে এক ধরনের ব্যঙ্গাত্মক গর্ব-এটাই আমাদের “জাতীয় ব্র্যান্ডিং।” পাটের পর এটিই সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত “রপ্তানি পণ্য।” পার্থক্য শুধু একটাই- এতে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা আসে না, আসে কেবল আন্তর্জাতিক লজ্জা আর হাসাহাসি। প্রশ্ন হলো-আমরা কি এই “ডিমতন্ত্র” থেকে বের হতে পারব? নাকি একদিন সত্যিই ইউনেস্কো ঘোষণা করবে-“ডিম-জুতা নিক্ষেপ বাংলাদেশের অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।” তখন হয়তো আমরা বুক ফুলিয়ে বলব-“হ্যাঁ, এটাই আমাদের জাতীয় গর্ব।” আর হয়তো গর্বের সাথেই যুক্ত হবে তিক্ত ব্যঙ্গ-কারণ এ ধরনের ঐতিহ্য কোনো জাতির উন্নতির চিহ্ন নয়, বরং হতাশার প্রকাশ।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।
www.mirabdulalim.com
মীর আব্দুল আলীম 



















