শিল্পের জগতে ভারত এখন এক নতুন অধ্যায়ের সাক্ষী। দেশীয় ক্রেতা এবং প্রবাসী ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ ভারতের আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকে বৈশ্বিক আলোচনায় নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিলামে রেকর্ড ভাঙা দাম, নতুন সংগ্রাহকদের আবির্ভাব এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভারতীয় শিল্পকে নতুন উচ্চতায় তুলেছে।
সমকালীন শিল্পের উত্থান
সুবোধ গুপ্তের মতো শিল্পীরা দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস দিয়ে সৃষ্ট অনন্য ভাস্কর্য দিয়ে বিশ্বে আলোড়ন তুলেছেন। দিল্লির সংগ্রাহক শালিনী পাশিরের বাড়িতে তাঁর কাজ “বুদ্ধ হেড” স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি এম.এফ. হুসেন ও এফ.এন. সৌজার কাজও ব্যাপক চাহিদা পাচ্ছে। ২০২৪ সালে আর্টসি নামক অনলাইন মার্কেটপ্লেসে ভারতীয় শিল্পীদের কাজের চাহিদাই ছিল সর্বোচ্চ। হুসেনের একটি চিত্রকর্ম ১৩.৮ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়ে আধুনিক ভারতীয় শিল্পের নতুন রেকর্ড গড়েছে।
অতীতের বুদবুদ, বর্তমানের স্থিতিশীলতা
২০০৬-০৭ সালে ভারতীয় শিল্পবাজারে একবার বড়সড় উত্থান হয়েছিল, কিন্তু তা আর্থিক মন্দায় ভেঙে পড়ে। সে সময় আন্তর্জাতিক জল্পনাকারীরা দাম বাড়ালেও বাজার ছিল অস্থিতিশীল। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। দিল্লির গ্যালারিস্ট রোশিনী বাদরার মতে, এখন দেশীয় ক্রেতারাই বাজারকে এগিয়ে নিচ্ছেন। ভারতের জিডিপি গত এক দশকের বেশি সময় ধরে গড়ে ৭ শতাংশের ওপরে থাকায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এবং শিল্পের দামও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
নতুন প্রজন্ম ও সামাজিক মর্যাদা
করোনা-পরবর্তী সময়ে ত্রিশ ও চল্লিশের কোঠার একদল নতুন ক্রেতা বাজারে এসেছে। তাঁদের কাছে দেয়ালে দামী শিল্পকর্ম শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। অভ্যন্তরীণ নকশাবিদরাও নতুন বাড়িঘরে শিল্পকর্মের ব্যবহার বাড়াচ্ছেন। কর্পোরেট ভবনগুলোতেও সমকালীন শিল্প জায়গা করে নিচ্ছে। যেমন, মুম্বাইয়ের মেকার ম্যাক্সিটি কমপ্লেক্সে নানা শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
ভারতের বাইরে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও ভারতীয় শিল্পের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। সোহরাব হুরার কাজ নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে প্রদর্শিত হয়েছে। অর্পিতা সিং লন্ডনের সার্পেন্টাইন গ্যালারিতে প্রথম একক প্রদর্শনী করেছেন। এসব আয়োজন প্রমাণ করে, ভারতীয় শিল্প বৈশ্বিক অঙ্গনে জায়গা করে নিচ্ছে।
সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
তবু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। “মডার্ন মাস্টারস” নামে পরিচিত হুসেন, সৌজা বা রাজার মতো শিল্পীরা উচ্চমূল্যে বিক্রি হলেও নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে এখনও ততজনকে আন্তর্জাতিকভাবে ‘ব্লু-চিপ’ ধরা হয় না। দেশীয় ক্রেতাদের মধ্যে অনেকেই প্রবণতা অনুসরণে অভ্যস্ত এবং দামের ব্যাপারে বেশি সংবেদনশীল। প্রবাসী ভারতীয় ক্রেতাদের অনেকে আবার শুধু ধর্মীয় চিত্রকর্মের প্রতিই আকৃষ্ট।
নীতি ও নিয়ন্ত্রণ
ভারতের সুরক্ষানীতি শিল্পক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছে। ১৯৭২ সালের প্রাচীন শিল্পকর্ম আইন শত বছরের বেশি পুরোনো যেকোনো শিল্পকর্ম রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। কিছু শিল্পীকে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা করায় তাঁদের কাজ দেশ থেকে বের করা যায় না। তাছাড়া শিল্প আমদানিতেও নানা জটিল নিয়ম রয়েছে, যা গ্যালারিস্টদের দুশ্চিন্তার কারণ।
ভবিষ্যতের দিশা
তবুও দেশীয় বাজার এতটাই শক্তিশালী যে এসব বাধা সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে থামাতে পারছে না। ভারতের শিল্পপরিমণ্ডলে তরুণ শিল্পীদের বিকাশের অবকাঠামো এখনও দুর্বল হলেও ধীরে ধীরে সেটি এগোচ্ছে। লন্ডন বা নিউ ইয়র্কের মতো বৈশ্বিক শিল্পবাজার হওয়ার চেয়ে ভারত হয়তো নিজের ভেতরেই সংগ্রাহক, জাদুঘর ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চাইছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে বিদেশি ক্রেতাদের ওপর ভারতের শিল্পীরা ততটা নির্ভরশীল নন। ফলে ভারতীয় শিল্পবাজার পরিণত হলেও তা তুলনামূলকভাবে স্বতন্ত্র ও সীমিত প্রভাব রাখবে বৈশ্বিক বাজারে।