০৮:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
অফিসে ফিরছে ওয়াই-টু-কে ফ্যাশন—জেন জেডের হাতে ড্রেস কোডের বদল মানসিক রোগের ভাইরাস কোথা থেকে আসছে হোক্কাইদোতে স্যামন রোর দাম চড়া—ধরা কম, খরচ বেশি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যার বিচার হবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯৪২ জন গণতন্ত্রের অধঃপতন ও ইতিহাসের উল্টোদিক—“স্বাধীনতার আত্মা” আবার জাগ্রত করার আহ্বান রাতে দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের হামলায় প্রাণ গেল ১৫ বছরের রুমানের জুলাই আন্দোলনের পরও রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ছে: দুঃখ প্রকাশ মির্জা ফখরুলের শুধু নির্গমন কমালেই হবে না—অভিযোজনেই জোর দিন: ডব্লিউএসজে মতামতধারার আলোচ্য রাজশাহীতে চারঘাট পৌরসভার পুকুরে ভেসে থাকা মরদেহে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গন্ধ

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -৪৪)

নাটোর রাজবংশ

নাটোর রাজবংশের উৎপত্তি-আদিশুর কান্যকুব্জ হইতে যে পঞ্চগোত্রীয় পাঁচজন ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আনেন, তন্মধ্যে কাশ্যপ গোত্রীয় সুযেনমণি একজন। এই সুষেনাদির পুত্রগণ বরেন্দ্রভূমে একশত গ্রামে বাস করেন। সুষেণ বংশের মতু নামক একব্যক্তি মৈত্র উপাধি প্রাপ্ত হন। মতু ও তাহার সন্তান কুলীন ছিল। ঐ বংশে জীবর মৈত্র’ নামক ব্যক্তি কুলচ্যুত হন। নাটোর রাজবংশের আদিপুরুষ কামদেব মৈত্র ঐ জীবর মৈত্রের বংশধর। ঐ কামদেব পুঠিয়ার রাজবংশের নরনারায়ণ ঠাকুরের অধীনে পরগণে লস্করপুরের অন্তর্গত বারইহাটা গ্রামের তহশীলদার ছিল। কামদেবের তিন পুত্র; রামজীবন, রঘুনন্দন ও বিষ্ণুরাম। তিন ভ্রাতা রাজধানীতে থাকিয়া তৎকালোপযোগী লেখাপড়া শিক্ষা করিতেন। এই সময় আরঙ্গজেব দিল্লির সম্রাট ছিলেন।

রঘুনন্দনের উন্নতি-এই তিন ভ্রাতার মধ্যে রঘুনন্দন বুদ্ধিমান এবং প্রতিভা গুণসম্পন্ন ছিলেন। ইহা কথিত আছে তিনি পুঠিয়া রাজসংসারে দেবপূজার পুষ্প সংগ্রহ করিবার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। এই জনশ্রুতি আছে যে এক দিবস ক্লান্ত হইয়া রঘুনন্দন পুষ্পোদ্যানে শয়ন করিয়া আছেন। একটি সর্প ফণা বিস্তার করিয়া তাহাকে সূর্যের রশ্মি হইতে রক্ষা করিতেছে। এটি রাজচিহ্ন বলিয়া প্রবাদ। রাজা দর্পনারায়ণ রায় এই সংবাদ পাইয়া রঘুনন্দনকে ডাকিলেন। রঘুনন্দন উপস্থিত হইলে রাজা দর্পনারায়ণ বলিলেন, “রঘুনন্দন তোমার রাজচক্রবর্তীর চিহ্ন দৃষ্ট হইতেছে, তুমি রাজচক্রবর্তী হইলে আমার বংশধরকে কখন রাজ্যচ্যুত করিতে পারিবে না; এই প্রতিজ্ঞা কর।” রঘুনন্দন স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে তিনি রাজা হইবেন। সুতরাং তিনি সহজে প্রতিজ্ঞা করিলেন যে “আমার দ্বারা পুঁঠিয়া রাজবংশের কোন অনিষ্ট হইবে না।” এই ঘটনার পর হইতে রঘুনন্দনের ভাগ্য প্রসন্ন হইল। রাজদরবারে রঘুনন্দনের বুদ্ধি ক্রমে বিকাশ পাইতে লাগিল। রঘুনন্দনকে বুদ্ধিমান ও কার্যদক্ষ জানিয়া রাজা দর্পনারায়ণ রায় ঢাকার নবাব দরবারে তাহাকে মোক্তার বা উকিল’ নিযুক্ত করিয়া পাঠান। সেই সময় এই প্রথা ছিল যে নবাব দরবারে কোন রাজা বা জমিদারের পক্ষে মোক্তার বা উকিল না থাকিলে তাহার রাজ্য রক্ষা হইত না। পুঁঠিয়া রাজার পক্ষে উকিল হওয়াই রঘুনন্দনের উন্নতির সোপান হয়। রঘুনন্দন মুরশিদাবাদে-এসময় মুরশিদকুলি খাঁ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব। তাহার রাজধানী ঢাকায় (জাহাঙ্গীরনগরে) ছিল। ঢাকায় যাওয়ার পর হইতে মুরশিদকুলি খাঁ রঘুনন্দনের বুদ্ধিমত্তা ও কার্যদক্ষতার গুণে আকৃষ্ট হইয়া তাহাকে বিশেষ অনুগ্রহ করিতে লাগিলেন। রঘুনন্দনের পরামর্শেই কুলি খাঁ দেওয়ানি কার্যালয় প্রভৃতি ঢাকা হইতে মুরশিদাবাদে উঠাইয়া আনেন। রঘুনন্দনের “নায়েব কানুনগো” এবং “রায় রায়াণ” পদ প্রাপ্তি-মুসলমান রাজ্যের আইন কানুন রঘুনন্দন অতি শীঘ্র শিক্ষা করিয়া বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিলেন এবং নবাবের যাবতীয় কর্মচারিদের সহিত পরিচিত হইয়া তাহাদের অনুগ্রহ লাভ করিলেন। বিশেষত প্রথম কানুনগোর মত, এত উৎকৃষ্ট হইয়াছিল যে রঘুনন্দনের ন্যায় সুযোগ্য কর্মচারী অতি বিরল। রঘুনন্দনের গুণে ও কর্মদক্ষতায়, প্রধান কানুনগো দর্পনারায়ণ সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে “নায়েব কানুনগোর” পদে নিযুক্ত করিলেন। কানুনগো সমগ্র সুবার ভূসম্পত্তির রেজেষ্ট্রার, পরগণা ও মৌজার সীমা, রাজস্ব সম্বন্ধীয় কার্য, ভূমি সম্বন্ধীয় প্রথা ও নিয়ম প্রভৃতি কানুনগোর দপ্তরের রিপোর্ট অনুসারে নবাব ও দিল্লির সম্রাট আদেশ দিতেন। বৎসর অন্তরে যাবতীয় রাজস্বের একটি হিসাব কানুনগোকে প্রস্তুত, মহর এবং স্বাক্ষর করিয়া প্রথমে নবাবের এবং পরে দিল্লির সম্রাট সমীপে পাঠাইতে হইত। এই কানুনগোদের দস্তখতী কাগজ ভিন্ন রাজসাহী খালসা দপ্তরে সুবার দেওয়ানের নিকাশ দিবার নিয়ম ছিল না। প্রথম কানুনগো দর্পনারায়ণ এবং দ্বিতীয় কানুনগো জয়নারায়ণকে দস্তখত জন্য অনুরোধ করা হইল কিন্তু কেহই দস্তখত করিল না। দর্পনারায়ণ ও জয়নারায়ণ নিকাশী কাগজে দস্তখত না করায় নবাব মুরশিদকুলি খাঁ বিপন্ন হইয়া রঘুনন্দনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। রঘুনন্দনও কানুনগোর মহর ও দস্তখত সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্র মহাশয় ১৩০৪ শকের বৈশাখ মাসের “সাহিত্যে” যাহা লিখিয়াছেন তাহা এস্থলে উদ্ধৃত করিলাম। “আজিমওযানের সহিত মুরশিদকুলি খাঁর মনোমালিন্যের পর কুলি খাঁ হিসাব লইয়া স্বয়ং বাদসাহ দরবারে গেলে সকল কথা পরিষ্কার করিয়া বলিবার অবসর পাইবেন এই চিন্তায় আজিমওযানের মুখ শুকাইল। তিনি কানুনগোগণকে শাসন করিয়া দিলেন যেন নিকাশী কাগজে দস্তখত না করেন। কানুনগোদ্বয় উভয় সঙ্কটে পড়েন। এদিকে কানুনগোর সহী না পাইয়া কুলি খাঁর মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল; অবশেষে অনন্যোপায় হইয়া রঘুনন্দনের স্মরণাগত হইলেন। রঘুনন্দনের চেষ্টায় একজন মাত্র কানুনগোর দস্তখত যুক্ত হিসাব ও উপঢৌকন লইয়া তিনি সম্রাটের নিকট গমন করেন। দাক্ষিণাত্য যুদ্ধে তখন অর্থের বড়ই অনটন, কুলি খাঁও বহু অর্থ লইয়া উপস্থিত, কাজেই একজন কানুনগোর দস্তখত খবরেই আসিল না।” নির্বিঘ্নে নিকাশী কাগজ বাদসাহর সরকারে দাখিল হইল। এই কার্যের পর হইতে রঘুনন্দনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। দেওয়ান ভূপতি রায়ের মৃত্যুর পর কানুনগো দর্পনারায়ণ দেওয়ানি কার্যের ভার গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর দর্পনারায়ণ পরলোক গমন করিলে, রঘুনন্দন দেওয়ান হন এবং “রায়রায়াণ” উপাধি প্রাপ্ত হন। “রায়রায়াণ” সুবার প্রধান কর্মচারী এবং দেওয়ানের নিম্নপদ। দেওয়ান সুবার নবারের প্রতিনিধি স্বরূপ। দেওয়ান পদ বহু সম্মানের। নবাব রাজশাসনে দুর্বল ও শিথিল হইলে দেওয়ানই সর্বময় কর্তা। পক্ষান্তরে নবাব কার্য দক্ষ হইলে, দেওয়ান নবাবের অধীন থাকিয়া তাহার আজ্ঞানুসারে নায়েব স্বরূপ রাজ্য শাসন করিতে সক্ষম। এক্ষণে রঘুনন্দন নবাব কুলি খাঁর “রায়রায়াণ” এবং “দেওয়ান”-সর্বময় কর্তা। রঘুনন্দনের নিকট কুলি খাঁ ঋণী এবং তাহারই যত্নে বাদসাহ দরবারে নিকাশ হইতে অব্যাহতি পান। নবাব কুলি খাঁ রাজস্ব বন্দোবস্তে প্রবৃত্ত হইলে রঘুনন্দন তাহাকে বিশেষ সাহায্য করিতে লাগিলেন। “মুরশিদকুলি খাঁর সুবিখ্যাত রাজস্ব বন্দোবস্তে দেওয়ান রঘুনন্দন তাহার দক্ষিণ হস্ত; প্রতিভা ও কর্ম কুশলতায় তিনি কুলি খাঁর উপযুক্ত সহকারি” ছিলেন। রঘুনন্দনের রাজ্যলাভ- ঢাকা হইতে মুরশিদাবাদে রাজধানী সংস্থাপনের পর মুরশিদকুলি খাঁ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সর্বময় কর্তা হইয়া উঠিলেন এবং রাজস্ব নির্ধারণ কার্যে হস্তক্ষেপ করিলেন। এই বৃহৎ কার্যে “রায়রায়াণ” রঘুনন্দন তাহার দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ হইয়া উঠিলেন। সমুদয় দেশ ১৩টি চাকলা, ৩৪ সরকার ও ১৬৬০ পরগণায় বিভক্ত হয়। এই বন্দোবস্তে বঙ্গের বার্ষিক রাজস্ব ১৪২৮৮১৮৬ টাকা নির্ধারিত হয়। এই রাজস্ব আদায়ের ভার নবাব মুরশিদকুলি খাঁর দৌহিত্রীপতি সৈয়দ রেজা খাঁর প্রতি অর্জিত হইল। রাজস্ব আদায়ের জন্য সৈয়দ রেজা খাঁ জমিদারগণের প্রতি বিশেষ দৌরাত্ম্য আরম্ভ করেন। তাহার দৌরাত্ম্য এরূপ অসহ্য হইয়া উঠিল যে কোন জমিদারের প্রাণ বিয়োগ হইল, কেহ বন্দি হইল এবং কেহ নির্বাসিত হইল। জমিদারগণের উত্তরাধিকারক্রমে জমিদারি দখল রাখিবার প্রথা থাকা সত্ত্বেও, রাজস্ব বাকির জন্য তাহাদের জমিদারি অন্য নূতন জমিদারের সহিত বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। এইরূপে নূতন নূতন জমিদার সৃষ্টি করা আবশ্যক হইল। ইহাই নাটোর রাজবংশের রাজ্য লাভের মূল সূত্র। নূতন নূতন জমিদার সৃষ্টির সময়, দেওয়ান রঘুনন্দন নিজ বৃদ্ধি কৌশলে নির্ধারিত রাজস্ব নিরুদ্বেগে আদায় করার ভানে আপন ভ্রাতা রামজীবনের নামে নূতন নূতন জমিদারি বন্দোবস্ত করিয়া দিতে লাগিলেন। রামজীবনও বাহুবলে প্রবল প্রতাপের সহিত রাজস্ব সংগ্রহ করিয়া নবাব সরকারের রীতিমত দাখিল করিতে লাগিলেন বলিয়া তাহার প্রতি নবাব ও দিল্লির সম্রাট সন্তুষ্ট হইলেন। ইহাই রাজা বিস্তারের সুযোগ হইল। নিম্নে সেই সকল জমিদারি প্রাপ্তির বিবরণ লিখিত হইল।

(১) বাংলা ১১১৩ সালে পরগণা বাণগাছির বিখ্যাত জমিদার গণেশরাম ও ভগবতীচরণ চৌধুরি, রাজস্ব প্রদান করিতে না পারায় রাজ্যচ্যুত হন। সেই পরগণা বাণগাছি দেওয়ান রঘুনন্দন কৌশল ক্রমে নিজ জ্যেষ্ঠ রামজীবনের নামে বন্দোবস্ত করিয়া দেন। নাটোর বংশের এই প্রথম রাজালাত।

(২) বাংলা ১১১৭ সালে পরগণা ভাতুড়িয়ার সাতুল রাজা রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, তাহার উত্তরাধিকারী তাহার পত্নী রাণী সর্বাণী ছিলেন। রাণী সর্বাণীর নামে দেওয়ান রঘুনন্দন সাঁতুল রাজ্যের কার্য নির্বাহ করিতে লাগিলেন। রাণীর মৃত্যুর পর দেওয়ান রঘুনন্দনের ভ্রাতা রামজীবন ভাতুড়িয়া পরগণার জমিদার হইলেন।

(৩) উদিত (উদয়) নারায়ণ সমগ্র রাজসাহীর জমিদার ছিলেন। স্বর্গীয় কিশোরীচাঁদ মিত্র বলেন যে বাংলা ১১২১ সালে দেওয়ান রঘুনন্দনের ভ্রাতা রামজীবনের নামে উদয় নারায়ণের সমগ্র জমিদারি বন্দোবস্ত হয়; কিন্তু শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিস্তীর্ণ রাজসাহীর জমিদারি ও রঘুনন্দন রামজীবন এবং কালুকোঙর- এই দুই নামে বন্দোবস্ত করিয়া লন”।” বাংলা ১১২২ সালে নবাব নলদাহ পরগণা রামজীবনকে প্রদান করেন।

(৪) উদয়নারায়ণের রাজসাহী জমিদারি রামজীবনের হস্তগত হইবার কিছুদিন পরে, যশোহরের জমিদার সীতরাম, ফৌজদার আবুতরাবকে বধ করার অপরাধে ধৃত হইয়া বন্দি হন। কিন্তু সীতারাম কারাগারে মৃত্যু হওয়ায় তাহার জমিদারি পরগণা ভূষণা, ইব্রাহিমপুর প্রভৃতি ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান রঘুনন্দনের ভ্রাতা রামজীবনের প্রতি অর্পিত হইল।

(৫) স্বর্গীয় কিশোরীচাঁদ মিত্র মহাশয় বলেন যে বাংলা ১১৩১ সালে রঘুনন্দনের মৃত্যু হয়। তাহার মৃত্যুর পর হাবিলী, মাহমুদপুর, সাহুজীয়ান, তুঞ্জী এবং স্বরূপপুর প্রভৃতির জমিদারগণ কিশোর খাঁ, সমসের খাঁ, এনাএত খাঁ এবং পরগণা পুকরীখার জমিদার ইছফিন্ডের বেগ নরহত্যা অপরাধে বন্দি হন, এবং নবাব তাহাদের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করিয়া রামজীবনকে অর্পণ করেন।

(৬) ইহার কিছুদিন পর জালালপুরের জমিদার এনাএত উল্লা রাজস্ব বাকি ফেলিয়া নবাব সরকারে সেই বাকি রাজস্ব পরিশোধ করার মানসে রামজীবনের নিকট তাহার জমিদারি বিক্রয় করে। এই রূপে একটি বিস্তৃত রাজ্য রামজীবনের অধিকৃত হইল।

নাটোর রাজবাটি নির্মাণ- লস্করপুর পরগণার অধীন তরফ কানাইখালির অন্তর্গত নাটোরে রাজবাটি নির্মাণ হয়। যে স্থানে রাজবাটি নির্মিত হয় সেই স্থান ছাইভাঙা নামক বিল বলিয়া পরিচিত ছিল। রাজবাটির চারিদিকে চৌকি বা পরিখায় বেষ্টিত। এইরূপ রাজবাটি নির্মাণ করিয়া প্রবল প্রতাপে রামজীবন রাজ্য শাসন করিতেছিলেন। ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে নবাবের অনুগ্রহে দিল্লি হইতে তিনি ২২ খান খেলাত এবং “রাজা বাহাদুর” উপাধিপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

নাটোর রাজ্যের সীমা- রামজীবনের সময় রাজসাহী জমিদারি বাংলার মধ্যে আয়তনে সর্বপ্রধান ছিল। শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন যে, “ইহার তদানীন্তন পরিমাণ বার হাজার বর্গমাইলেরও অধিক। “১০ ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে লস্করপুর পরগণা, তাহিরপুর পরগণা ও বারবাকপুর পরগণা ব্যতীত বর্তমান সমগ্র রাজসাহী, পাবনা ও বগুড়া এবং ফরিদপুর, ঢাকা, যশোহর, সাঁওতাল পরগণা, ভাগলপুর, মুরশিদাবাদ, বীরভূম, দিনাজপুর, মালদহ এবং রঙ্গুরের কিয়দংশ রামজীবনের অধিকৃত ছিল। স্বর্গীয় কিশোরীচাঁদ মিত্র মহাশয় বলেন যে “ইহা সাধারণত ৫২ লক্ষের জমিদারি”।১১ শ্রীযুক্ত কালীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন যে “সর্বসমেত ১৩৯ পরগণার ইহার সদর জমা ১৬৯৬০৮৭ টাকা খালসা সেরেস্তায় লিখিত হয়।

জনপ্রিয় সংবাদ

অফিসে ফিরছে ওয়াই-টু-কে ফ্যাশন—জেন জেডের হাতে ড্রেস কোডের বদল

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -৪৪)

০৪:৪৫:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫

নাটোর রাজবংশ

নাটোর রাজবংশের উৎপত্তি-আদিশুর কান্যকুব্জ হইতে যে পঞ্চগোত্রীয় পাঁচজন ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আনেন, তন্মধ্যে কাশ্যপ গোত্রীয় সুযেনমণি একজন। এই সুষেনাদির পুত্রগণ বরেন্দ্রভূমে একশত গ্রামে বাস করেন। সুষেণ বংশের মতু নামক একব্যক্তি মৈত্র উপাধি প্রাপ্ত হন। মতু ও তাহার সন্তান কুলীন ছিল। ঐ বংশে জীবর মৈত্র’ নামক ব্যক্তি কুলচ্যুত হন। নাটোর রাজবংশের আদিপুরুষ কামদেব মৈত্র ঐ জীবর মৈত্রের বংশধর। ঐ কামদেব পুঠিয়ার রাজবংশের নরনারায়ণ ঠাকুরের অধীনে পরগণে লস্করপুরের অন্তর্গত বারইহাটা গ্রামের তহশীলদার ছিল। কামদেবের তিন পুত্র; রামজীবন, রঘুনন্দন ও বিষ্ণুরাম। তিন ভ্রাতা রাজধানীতে থাকিয়া তৎকালোপযোগী লেখাপড়া শিক্ষা করিতেন। এই সময় আরঙ্গজেব দিল্লির সম্রাট ছিলেন।

রঘুনন্দনের উন্নতি-এই তিন ভ্রাতার মধ্যে রঘুনন্দন বুদ্ধিমান এবং প্রতিভা গুণসম্পন্ন ছিলেন। ইহা কথিত আছে তিনি পুঠিয়া রাজসংসারে দেবপূজার পুষ্প সংগ্রহ করিবার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। এই জনশ্রুতি আছে যে এক দিবস ক্লান্ত হইয়া রঘুনন্দন পুষ্পোদ্যানে শয়ন করিয়া আছেন। একটি সর্প ফণা বিস্তার করিয়া তাহাকে সূর্যের রশ্মি হইতে রক্ষা করিতেছে। এটি রাজচিহ্ন বলিয়া প্রবাদ। রাজা দর্পনারায়ণ রায় এই সংবাদ পাইয়া রঘুনন্দনকে ডাকিলেন। রঘুনন্দন উপস্থিত হইলে রাজা দর্পনারায়ণ বলিলেন, “রঘুনন্দন তোমার রাজচক্রবর্তীর চিহ্ন দৃষ্ট হইতেছে, তুমি রাজচক্রবর্তী হইলে আমার বংশধরকে কখন রাজ্যচ্যুত করিতে পারিবে না; এই প্রতিজ্ঞা কর।” রঘুনন্দন স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে তিনি রাজা হইবেন। সুতরাং তিনি সহজে প্রতিজ্ঞা করিলেন যে “আমার দ্বারা পুঁঠিয়া রাজবংশের কোন অনিষ্ট হইবে না।” এই ঘটনার পর হইতে রঘুনন্দনের ভাগ্য প্রসন্ন হইল। রাজদরবারে রঘুনন্দনের বুদ্ধি ক্রমে বিকাশ পাইতে লাগিল। রঘুনন্দনকে বুদ্ধিমান ও কার্যদক্ষ জানিয়া রাজা দর্পনারায়ণ রায় ঢাকার নবাব দরবারে তাহাকে মোক্তার বা উকিল’ নিযুক্ত করিয়া পাঠান। সেই সময় এই প্রথা ছিল যে নবাব দরবারে কোন রাজা বা জমিদারের পক্ষে মোক্তার বা উকিল না থাকিলে তাহার রাজ্য রক্ষা হইত না। পুঁঠিয়া রাজার পক্ষে উকিল হওয়াই রঘুনন্দনের উন্নতির সোপান হয়। রঘুনন্দন মুরশিদাবাদে-এসময় মুরশিদকুলি খাঁ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব। তাহার রাজধানী ঢাকায় (জাহাঙ্গীরনগরে) ছিল। ঢাকায় যাওয়ার পর হইতে মুরশিদকুলি খাঁ রঘুনন্দনের বুদ্ধিমত্তা ও কার্যদক্ষতার গুণে আকৃষ্ট হইয়া তাহাকে বিশেষ অনুগ্রহ করিতে লাগিলেন। রঘুনন্দনের পরামর্শেই কুলি খাঁ দেওয়ানি কার্যালয় প্রভৃতি ঢাকা হইতে মুরশিদাবাদে উঠাইয়া আনেন। রঘুনন্দনের “নায়েব কানুনগো” এবং “রায় রায়াণ” পদ প্রাপ্তি-মুসলমান রাজ্যের আইন কানুন রঘুনন্দন অতি শীঘ্র শিক্ষা করিয়া বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিলেন এবং নবাবের যাবতীয় কর্মচারিদের সহিত পরিচিত হইয়া তাহাদের অনুগ্রহ লাভ করিলেন। বিশেষত প্রথম কানুনগোর মত, এত উৎকৃষ্ট হইয়াছিল যে রঘুনন্দনের ন্যায় সুযোগ্য কর্মচারী অতি বিরল। রঘুনন্দনের গুণে ও কর্মদক্ষতায়, প্রধান কানুনগো দর্পনারায়ণ সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে “নায়েব কানুনগোর” পদে নিযুক্ত করিলেন। কানুনগো সমগ্র সুবার ভূসম্পত্তির রেজেষ্ট্রার, পরগণা ও মৌজার সীমা, রাজস্ব সম্বন্ধীয় কার্য, ভূমি সম্বন্ধীয় প্রথা ও নিয়ম প্রভৃতি কানুনগোর দপ্তরের রিপোর্ট অনুসারে নবাব ও দিল্লির সম্রাট আদেশ দিতেন। বৎসর অন্তরে যাবতীয় রাজস্বের একটি হিসাব কানুনগোকে প্রস্তুত, মহর এবং স্বাক্ষর করিয়া প্রথমে নবাবের এবং পরে দিল্লির সম্রাট সমীপে পাঠাইতে হইত। এই কানুনগোদের দস্তখতী কাগজ ভিন্ন রাজসাহী খালসা দপ্তরে সুবার দেওয়ানের নিকাশ দিবার নিয়ম ছিল না। প্রথম কানুনগো দর্পনারায়ণ এবং দ্বিতীয় কানুনগো জয়নারায়ণকে দস্তখত জন্য অনুরোধ করা হইল কিন্তু কেহই দস্তখত করিল না। দর্পনারায়ণ ও জয়নারায়ণ নিকাশী কাগজে দস্তখত না করায় নবাব মুরশিদকুলি খাঁ বিপন্ন হইয়া রঘুনন্দনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। রঘুনন্দনও কানুনগোর মহর ও দস্তখত সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্র মহাশয় ১৩০৪ শকের বৈশাখ মাসের “সাহিত্যে” যাহা লিখিয়াছেন তাহা এস্থলে উদ্ধৃত করিলাম। “আজিমওযানের সহিত মুরশিদকুলি খাঁর মনোমালিন্যের পর কুলি খাঁ হিসাব লইয়া স্বয়ং বাদসাহ দরবারে গেলে সকল কথা পরিষ্কার করিয়া বলিবার অবসর পাইবেন এই চিন্তায় আজিমওযানের মুখ শুকাইল। তিনি কানুনগোগণকে শাসন করিয়া দিলেন যেন নিকাশী কাগজে দস্তখত না করেন। কানুনগোদ্বয় উভয় সঙ্কটে পড়েন। এদিকে কানুনগোর সহী না পাইয়া কুলি খাঁর মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল; অবশেষে অনন্যোপায় হইয়া রঘুনন্দনের স্মরণাগত হইলেন। রঘুনন্দনের চেষ্টায় একজন মাত্র কানুনগোর দস্তখত যুক্ত হিসাব ও উপঢৌকন লইয়া তিনি সম্রাটের নিকট গমন করেন। দাক্ষিণাত্য যুদ্ধে তখন অর্থের বড়ই অনটন, কুলি খাঁও বহু অর্থ লইয়া উপস্থিত, কাজেই একজন কানুনগোর দস্তখত খবরেই আসিল না।” নির্বিঘ্নে নিকাশী কাগজ বাদসাহর সরকারে দাখিল হইল। এই কার্যের পর হইতে রঘুনন্দনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। দেওয়ান ভূপতি রায়ের মৃত্যুর পর কানুনগো দর্পনারায়ণ দেওয়ানি কার্যের ভার গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর দর্পনারায়ণ পরলোক গমন করিলে, রঘুনন্দন দেওয়ান হন এবং “রায়রায়াণ” উপাধি প্রাপ্ত হন। “রায়রায়াণ” সুবার প্রধান কর্মচারী এবং দেওয়ানের নিম্নপদ। দেওয়ান সুবার নবারের প্রতিনিধি স্বরূপ। দেওয়ান পদ বহু সম্মানের। নবাব রাজশাসনে দুর্বল ও শিথিল হইলে দেওয়ানই সর্বময় কর্তা। পক্ষান্তরে নবাব কার্য দক্ষ হইলে, দেওয়ান নবাবের অধীন থাকিয়া তাহার আজ্ঞানুসারে নায়েব স্বরূপ রাজ্য শাসন করিতে সক্ষম। এক্ষণে রঘুনন্দন নবাব কুলি খাঁর “রায়রায়াণ” এবং “দেওয়ান”-সর্বময় কর্তা। রঘুনন্দনের নিকট কুলি খাঁ ঋণী এবং তাহারই যত্নে বাদসাহ দরবারে নিকাশ হইতে অব্যাহতি পান। নবাব কুলি খাঁ রাজস্ব বন্দোবস্তে প্রবৃত্ত হইলে রঘুনন্দন তাহাকে বিশেষ সাহায্য করিতে লাগিলেন। “মুরশিদকুলি খাঁর সুবিখ্যাত রাজস্ব বন্দোবস্তে দেওয়ান রঘুনন্দন তাহার দক্ষিণ হস্ত; প্রতিভা ও কর্ম কুশলতায় তিনি কুলি খাঁর উপযুক্ত সহকারি” ছিলেন। রঘুনন্দনের রাজ্যলাভ- ঢাকা হইতে মুরশিদাবাদে রাজধানী সংস্থাপনের পর মুরশিদকুলি খাঁ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সর্বময় কর্তা হইয়া উঠিলেন এবং রাজস্ব নির্ধারণ কার্যে হস্তক্ষেপ করিলেন। এই বৃহৎ কার্যে “রায়রায়াণ” রঘুনন্দন তাহার দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ হইয়া উঠিলেন। সমুদয় দেশ ১৩টি চাকলা, ৩৪ সরকার ও ১৬৬০ পরগণায় বিভক্ত হয়। এই বন্দোবস্তে বঙ্গের বার্ষিক রাজস্ব ১৪২৮৮১৮৬ টাকা নির্ধারিত হয়। এই রাজস্ব আদায়ের ভার নবাব মুরশিদকুলি খাঁর দৌহিত্রীপতি সৈয়দ রেজা খাঁর প্রতি অর্জিত হইল। রাজস্ব আদায়ের জন্য সৈয়দ রেজা খাঁ জমিদারগণের প্রতি বিশেষ দৌরাত্ম্য আরম্ভ করেন। তাহার দৌরাত্ম্য এরূপ অসহ্য হইয়া উঠিল যে কোন জমিদারের প্রাণ বিয়োগ হইল, কেহ বন্দি হইল এবং কেহ নির্বাসিত হইল। জমিদারগণের উত্তরাধিকারক্রমে জমিদারি দখল রাখিবার প্রথা থাকা সত্ত্বেও, রাজস্ব বাকির জন্য তাহাদের জমিদারি অন্য নূতন জমিদারের সহিত বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। এইরূপে নূতন নূতন জমিদার সৃষ্টি করা আবশ্যক হইল। ইহাই নাটোর রাজবংশের রাজ্য লাভের মূল সূত্র। নূতন নূতন জমিদার সৃষ্টির সময়, দেওয়ান রঘুনন্দন নিজ বৃদ্ধি কৌশলে নির্ধারিত রাজস্ব নিরুদ্বেগে আদায় করার ভানে আপন ভ্রাতা রামজীবনের নামে নূতন নূতন জমিদারি বন্দোবস্ত করিয়া দিতে লাগিলেন। রামজীবনও বাহুবলে প্রবল প্রতাপের সহিত রাজস্ব সংগ্রহ করিয়া নবাব সরকারের রীতিমত দাখিল করিতে লাগিলেন বলিয়া তাহার প্রতি নবাব ও দিল্লির সম্রাট সন্তুষ্ট হইলেন। ইহাই রাজা বিস্তারের সুযোগ হইল। নিম্নে সেই সকল জমিদারি প্রাপ্তির বিবরণ লিখিত হইল।

(১) বাংলা ১১১৩ সালে পরগণা বাণগাছির বিখ্যাত জমিদার গণেশরাম ও ভগবতীচরণ চৌধুরি, রাজস্ব প্রদান করিতে না পারায় রাজ্যচ্যুত হন। সেই পরগণা বাণগাছি দেওয়ান রঘুনন্দন কৌশল ক্রমে নিজ জ্যেষ্ঠ রামজীবনের নামে বন্দোবস্ত করিয়া দেন। নাটোর বংশের এই প্রথম রাজালাত।

(২) বাংলা ১১১৭ সালে পরগণা ভাতুড়িয়ার সাতুল রাজা রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, তাহার উত্তরাধিকারী তাহার পত্নী রাণী সর্বাণী ছিলেন। রাণী সর্বাণীর নামে দেওয়ান রঘুনন্দন সাঁতুল রাজ্যের কার্য নির্বাহ করিতে লাগিলেন। রাণীর মৃত্যুর পর দেওয়ান রঘুনন্দনের ভ্রাতা রামজীবন ভাতুড়িয়া পরগণার জমিদার হইলেন।

(৩) উদিত (উদয়) নারায়ণ সমগ্র রাজসাহীর জমিদার ছিলেন। স্বর্গীয় কিশোরীচাঁদ মিত্র বলেন যে বাংলা ১১২১ সালে দেওয়ান রঘুনন্দনের ভ্রাতা রামজীবনের নামে উদয় নারায়ণের সমগ্র জমিদারি বন্দোবস্ত হয়; কিন্তু শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিস্তীর্ণ রাজসাহীর জমিদারি ও রঘুনন্দন রামজীবন এবং কালুকোঙর- এই দুই নামে বন্দোবস্ত করিয়া লন”।” বাংলা ১১২২ সালে নবাব নলদাহ পরগণা রামজীবনকে প্রদান করেন।

(৪) উদয়নারায়ণের রাজসাহী জমিদারি রামজীবনের হস্তগত হইবার কিছুদিন পরে, যশোহরের জমিদার সীতরাম, ফৌজদার আবুতরাবকে বধ করার অপরাধে ধৃত হইয়া বন্দি হন। কিন্তু সীতারাম কারাগারে মৃত্যু হওয়ায় তাহার জমিদারি পরগণা ভূষণা, ইব্রাহিমপুর প্রভৃতি ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান রঘুনন্দনের ভ্রাতা রামজীবনের প্রতি অর্পিত হইল।

(৫) স্বর্গীয় কিশোরীচাঁদ মিত্র মহাশয় বলেন যে বাংলা ১১৩১ সালে রঘুনন্দনের মৃত্যু হয়। তাহার মৃত্যুর পর হাবিলী, মাহমুদপুর, সাহুজীয়ান, তুঞ্জী এবং স্বরূপপুর প্রভৃতির জমিদারগণ কিশোর খাঁ, সমসের খাঁ, এনাএত খাঁ এবং পরগণা পুকরীখার জমিদার ইছফিন্ডের বেগ নরহত্যা অপরাধে বন্দি হন, এবং নবাব তাহাদের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করিয়া রামজীবনকে অর্পণ করেন।

(৬) ইহার কিছুদিন পর জালালপুরের জমিদার এনাএত উল্লা রাজস্ব বাকি ফেলিয়া নবাব সরকারে সেই বাকি রাজস্ব পরিশোধ করার মানসে রামজীবনের নিকট তাহার জমিদারি বিক্রয় করে। এই রূপে একটি বিস্তৃত রাজ্য রামজীবনের অধিকৃত হইল।

নাটোর রাজবাটি নির্মাণ- লস্করপুর পরগণার অধীন তরফ কানাইখালির অন্তর্গত নাটোরে রাজবাটি নির্মাণ হয়। যে স্থানে রাজবাটি নির্মিত হয় সেই স্থান ছাইভাঙা নামক বিল বলিয়া পরিচিত ছিল। রাজবাটির চারিদিকে চৌকি বা পরিখায় বেষ্টিত। এইরূপ রাজবাটি নির্মাণ করিয়া প্রবল প্রতাপে রামজীবন রাজ্য শাসন করিতেছিলেন। ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে নবাবের অনুগ্রহে দিল্লি হইতে তিনি ২২ খান খেলাত এবং “রাজা বাহাদুর” উপাধিপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

নাটোর রাজ্যের সীমা- রামজীবনের সময় রাজসাহী জমিদারি বাংলার মধ্যে আয়তনে সর্বপ্রধান ছিল। শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন যে, “ইহার তদানীন্তন পরিমাণ বার হাজার বর্গমাইলেরও অধিক। “১০ ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে লস্করপুর পরগণা, তাহিরপুর পরগণা ও বারবাকপুর পরগণা ব্যতীত বর্তমান সমগ্র রাজসাহী, পাবনা ও বগুড়া এবং ফরিদপুর, ঢাকা, যশোহর, সাঁওতাল পরগণা, ভাগলপুর, মুরশিদাবাদ, বীরভূম, দিনাজপুর, মালদহ এবং রঙ্গুরের কিয়দংশ রামজীবনের অধিকৃত ছিল। স্বর্গীয় কিশোরীচাঁদ মিত্র মহাশয় বলেন যে “ইহা সাধারণত ৫২ লক্ষের জমিদারি”।১১ শ্রীযুক্ত কালীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন যে “সর্বসমেত ১৩৯ পরগণার ইহার সদর জমা ১৬৯৬০৮৭ টাকা খালসা সেরেস্তায় লিখিত হয়।