যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন দমননীতি ও সম্ভাব্য কর আরোপের আশঙ্কায় লাখো অনিবন্ধিত শ্রমিক দ্রুত দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। ফলে লাতিন আমেরিকার দুর্বল অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়ে রেকর্ড ছুঁয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অনিশ্চয়তা, দেশে অর্থপ্রবাহ
নিউইয়র্কের এক ইকুয়েডরীয় রেস্তোরাঁ কর্মী কেভিন এম বলেন, “আমি জানি না আগামীকাল কী হবে। তাই যত পারি, এখনই দেশে পাঠাচ্ছি।”
জানুয়ারিতে ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর প্রশাসন জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ২০ লাখেরও বেশি মানুষকে দেশ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৪ লাখকে সরাসরি বহিষ্কার করা হয়েছে। এই পরিস্থিতি অনিবন্ধিত অভিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ও জরুরি অর্থপ্রেরণের তাগিদ তৈরি করেছে।
রেমিট্যান্সের নতুন রেকর্ড
ফিনটেক বিশ্লেষক সংস্থা PYMNTS জানিয়েছে, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লাতিন আমেরিকায় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।
হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, এল সালভাদর ও হাইতির মতো দেশগুলোর পরিবারের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস এই রেমিট্যান্স। বিশেষ করে হন্ডুরাসে ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তঃআমেরিকান ডায়ালগের ম্যানুয়েল ওরোজকো বলেন, “অভিবাসীরা জানেন, তারা ফিরলে আর পাঠাতে পারবেন না — তাই এখন যতটা সম্ভব পাঠাচ্ছেন।”
“ক্যাশ আউট” পরিস্থিতি
ওরোজকোর হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গড় রেমিট্যান্সের অঙ্ক ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে প্রায় ৪০০ ডলার হয়েছে। তবে এই বৃদ্ধি স্থায়ী হবে না বলে তিনি মনে করেন।
“২০২৬ সালে হয়তো এই গতি থাকবে না, কারণ অভিবাসীরা তাদের সামর্থ্যের চেয়েও বেশি পাঠাচ্ছেন,” বলেন তিনি।
তিনি সতর্ক করে দেন, রেমিট্যান্স মাত্র ৫ শতাংশ কমলে গুয়াতেমালার জিডিপি এক শতাংশ কমে যেতে পারে।
কর আরোপ ও আতঙ্কের অর্থনীতি
২০২৫ সালের জুলাইয়ে কংগ্রেস ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ পাস করে, যেখানে বিদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সে ১ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব রয়েছে — যা ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
এই কর শুধু নগদ, মানি অর্ডার বা ক্যাশিয়ার চেকের মাধ্যমে পাঠানো অর্থে প্রযোজ্য; ব্যাংক ট্রান্সফার বা কার্ডে পাঠানো অর্থ এর বাইরে থাকবে। এতে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে নির্ভর অভিবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
অভিবাসীদের বাস্তব সংকট
কলম্বিয়ার এক মার্কিন নাগরিক আলেয়দা ভেলাসকেজ বলেন, “অনেকে নিজেদের সঞ্চয়, এমনকি জিনিসপত্র বিক্রি করে পাঠাচ্ছে। কেউ কেউ বিশ্বাসযোগ্য মানুষকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে রেখে যাচ্ছে।”
তিনি জানান, রেমিট্যান্স প্ল্যাটফর্মগুলো চাহিদা বাড়ায় ফি বাড়িয়েছে, তবুও অভিবাসীরা থামছেন না — তাদের কাছে সময় যেন ফুরিয়ে আসছে।
দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব
কলম্বিয়া ২০২৪ সালে রেমিট্যান্সে রেকর্ড ১১.৮ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে, যার ৫৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে। কর কার্যকর হলে ৬০ থেকে ৩৬০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত প্রবাহ কমতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে স্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান করফিকোলম্বিয়ানা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামষ্টিক অর্থনীতি টিকলেও পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ রেমিট্যান্সের ৮০ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে।
বিতর্ক: অর্থ থাকা উচিত কোথায়
রিপাবলিকান সদস্যরা দাবি করছেন, অভিবাসীদের পাঠানো অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই থাকা উচিত।
ফেডারেশন ফর আমেরিকান ইমিগ্রেশন রিফর্মের মিডিয়া পরিচালক আইরা মেহলম্যান বলেন, “রেমিট্যান্স দ্বিমুখী তলোয়ার — এটি যেমন পরিবারের সহায়তা করে, তেমনি নির্ভরতা বাড়িয়ে স্থানীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।”
অন্যদিকে সমালোচকেরা বলছেন, কর আরোপ অভিবাসন আরও বাড়াতে পারে, কমাবে না। গবেষক রুবি ব্লেডসো বলেন, “রেমিট্যান্স কমলে অনেকেই শেষ অবলম্বন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ খুঁজতে আসবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “অবৈধ অভিবাসীরাও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; তারা শ্রমশক্তি সরবরাহের পাশাপাশি করও দেয় — কিন্তু সুবিধাগুলো নিজেরা পায় না।”
অভিবাসী কেভিনের মতো মানুষের জন্য বিষয়টি সরল — “যদি ফিরে যেতে হয়, কিছুই পাঠাতে পারব না। তাই এখনই পাঠাচ্ছি, যতটা পারি।”
#রেমিট্যান্স #অভিবাসননীতি #লাতিনআমেরিকা #ট্রাম্প #যুক্তরাষ্ট্রঅর্থনীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট