রাজধানীতে আয়োজিত এক সংলাপে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্য শুধু প্রশাসনিক সমস্যার ইঙ্গিতই দেয়নি, বরং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির গভীর সংকেতও বহন করেছে। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক অচলাবস্থা এবং গণমাধ্যম সংস্কার উদ্যোগের বাস্তবতা।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ক্ষমতার অস্থিরতা
মাহফুজ আলম সরাসরি বলেছেন যে, ‘গদি কখন চলে যায়’—এই প্রশ্নে তিনি নিজেই ক্রাইসিসে আছেন। এটি সরকারের ভেতরকার আস্থাহীনতার প্রতিফলন।
- ছাত্র উপদেষ্টাদের দপ্তর বন্ধ হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক গুঞ্জনের সরাসরি প্রভাব।
- আমলাদের মধ্যেও অপেক্ষার মানসিকতা তৈরি হয়েছে—কারা থাকবেন, কারা চলে যাবেন, তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে।
এটি বোঝায়, প্রশাসনিক স্তরে স্থিতিশীলতা হারাচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের হিসাব-নিকাশ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

লন্ডন বৈঠকের প্রভাব
১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বৈঠকের পর দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
- বৈঠক শেষে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ঘোষণা আসে।
- এই বৈঠক প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মাহফুজ আলমের ভাষায়, এই পরিবর্তনই মূলত আমলাদের দ্বিধা ও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার স্থবিরতার কারণ।
গণমাধ্যম নীতিমালা ও সংস্কারের অচলাবস্থা
তথ্য উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন যে সম্প্রচার নীতিমালা, গণমাধ্যম কমিশন, সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড বা বিটিভি-বেতারের স্বায়ত্তশাসন—সবকিছুই আটকে আছে।
- শেখ হাসিনার সময় শুরু হওয়া সম্প্রচার নীতিমালা শেষ হয়নি।
- নতুন সরকার এলে বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা জাগলে তবেই এ ধরনের সংস্কার সম্ভব হবে।
- আমলারা নীরবে অপেক্ষা করছেন—পরবর্তী সরকার কারা আনবে, তাদের অধীনে আইন হবে কিনা, সেটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে।
এখানে বোঝা যায়, নীতি প্রণয়নের সক্ষমতা থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রশাসনিক অনিচ্ছা প্রকৃত সংস্কারকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বিটিভি-বেতারের স্বায়ত্তশাসন: সুযোগ বনাম জটিলতা
বিটিভি ও বেতারকে একীভূত করার বিষয়ে উপদেষ্টা ইতিবাচক হলেও বাস্তব সমস্যার দিক তুলে ধরেছেন:
- বেতারের প্রায় ৮০০ কর্মকর্তা সরকারি সার্ভিসে আছেন, যাদের আইনি কারণে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রাখা কঠিন।
- প্রচুর অব্যবহৃত জায়গা ও অবকাঠামো রয়েছে, যা সংস্কারের সুযোগ তৈরি করে।
এটি দেখায়, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা থাকলেও কাঠামোগত বাধা ও প্রশাসনিক জটিলতা সংস্কারকে এগোতে দিচ্ছে না।

সার্বিক বিশ্লেষণ
১. রাজনৈতিক সংকেত – তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্য সরকারের ভেতরকার আস্থাহীনতা ও ক্ষমতার অস্থিরতা প্রকাশ করছে।
২. প্রশাসনিক অচলাবস্থা – আমলাদের ‘অপেক্ষার সংস্কৃতি’ নীতি প্রণয়নকে থামিয়ে দিয়েছে।
৩. গণমাধ্যম সংস্কার ব্যর্থতা – সম্প্রচার নীতিমালা ও কমিশন গঠনের মতো উদ্যোগগুলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এগোয়নি।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক সংকট – বিটিভি-বেতার একীভূত করার সম্ভাবনা থাকলেও আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতায় তা আটকে আছে।
৫. অবস্থানগত বিভাজন – বাসসের স্বতন্ত্র থাকার ইচ্ছা সরকারের সামগ্রিক গণমাধ্যম সংস্কার পরিকল্পনায় বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্য মূলত এক ধরনের সতর্কবার্তা—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনো প্রশাসনিক বা নীতি সংস্কার সম্ভব নয়। লন্ডন বৈঠকের পর দেশে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা শুধু রাজনীতিকদের মধ্যে নয়, আমলাদের মধ্যেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে তথ্যপ্রযুক্তি, গণমাধ্যম নীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















