ব্যাপক অভিযানের চিত্র
সৌদি আরব গত এক সপ্তাহে অবৈধভাবে বসবাসকারী হাজারো বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১৮ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যৌথ অভিযানে মোট ১৮ হাজার ৪২১ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ৫৫২ জন আবাসন আইন, ৩ হাজার ৮৫২ জন সীমান্ত আইন এবং ৪ হাজার ১৭ জন শ্রম আইন ভঙ্গের দায়ে গ্রেপ্তার হন।
এর মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার অবৈধ বাসিন্দাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আটক হওয়া আরও প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে নিজ নিজ দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে ভ্রমণ নথি সংগ্রহের জন্য। পাশাপাশি এক হাজারেরও বেশি লোককে ভ্রমণের বুকিং সম্পন্ন করতে পাঠানো হয়। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশের সময়ও বহু মানুষ ধরা পড়ে, যাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ ইয়েমেনি, ৫১ শতাংশ ইথিওপিয়ান এবং বাকিরা বিভিন্ন দেশের নাগরিক।
কঠোর আইন ও শাস্তির বিধান
অভিযানের সময় অবৈধ প্রবেশকারীদের সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় যারা আশ্রয়, পরিবহন বা চাকরির ব্যবস্থা করছিলেন। বর্তমানে ৩০ হাজারেরও বেশি প্রবাসীর বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া চলছে। সৌদি আইনে এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ১৫ বছরের কারাদণ্ড, প্রায় ২ লাখ ৬৭ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ জরিমানা এবং অপরাধে ব্যবহৃত যানবাহন বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশিদের পরিস্থিতি
সৌদি আরব বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার। বর্তমানে সেখানে প্রায় ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মরত। এরা মূলত নির্মাণ, গৃহকর্ম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সেবাখাতে নিয়োজিত। তবে তাদের অবস্থান সবসময়ই অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ।
গবেষণা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক দেশটিতে চরম শোষণের শিকার। চাকরির চুক্তি অনুযায়ী মজুরি না দেওয়া, মাসের পর মাস বেতন আটকে রাখা, নিরাপত্তাহীন কর্মপরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা এবং পাসপোর্ট আটকে রাখার মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটে। অনেক শ্রমিক বিপুল অর্থ খরচ করে ভিসা সংগ্রহ করলেও বাস্তবে “ফ্রি ভিসা” বা অবৈধ শ্রমের ফাঁদে পড়ে যান।
এ ছাড়া নারী গৃহকর্মীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনাও কম নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সম্প্রতি সৌদির মেগা প্রকল্পগুলোতে বাংলাদেশিসহ বহু এশীয় শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা নথিবদ্ধ করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব মৃত্যু ‘স্বাভাবিক’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়, তদন্ত বা ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ দেখা যায় না।
নির্বাসন ও ফেরত আসা শ্রমিক
সাম্প্রতিক অভিযানে বাংলাদেশিরাও আটক ও ফেরত পাঠানোর শিকার হয়েছেন। দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের অনেকেই জানান, বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করেই তাদের আটক করা হয়। অনেকের ভিসা নবায়নের দায়িত্ব নিয়োগকর্তা না নেওয়ায় তারাই অভিযানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন।

ফলে দেশে ফিরে তাদের সামনে দাঁড়ায় ঋণের বোঝা, কর্মহীনতা ও সামাজিক সংকট। অনেকে পরিবার চালানোর টাকাটুকুও জোগাড় করতে পারেন না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের দূতাবাস ও কল্যাণ তহবিল কিছুটা সহায়তা করলেও তা বৃহৎ পরিসরে কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিবাসী অধিকারকর্মীরা মনে করেন।
প্রবাসী নীতির দুর্বলতা
বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে শ্রমচুক্তি থাকলেও তা বাস্তবে খুব একটা কার্যকর নয়। কফালা বা স্পন্সরশিপ ব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান থাকায় নিয়োগকর্তার হাতে শ্রমিকরা কার্যত বন্দি। চাকরি পরিবর্তন বা দেশে ফেরার স্বাধীনতাও নেই তাদের। এ কারণে শ্রমিকরা শোষণ, নির্যাতন বা বেতন না পাওয়ার পরও নীরবে সহ্য করতে বাধ্য হন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় বাংলাদেশকে আরও জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দালালচক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা, প্রকৃত খরচের সীমা নির্ধারণ, বিদেশে শ্রমিকদের জন্য আইনগত সহায়তা ও জরুরি সহায়তা তহবিল বাড়ানো জরুরি হয়ে উঠেছে।
ভবিষ্যৎ পথচলা
সৌদির অভিযানের সর্বশেষ ঘটনাগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে, অবৈধ অবস্থান বা দুর্বল আইনগত সুরক্ষা নিয়ে প্রবাস জীবন কতটা অনিশ্চিত। শ্রমবাজার ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশকে একদিকে যেমন বৈধ অভিবাসন ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে, অন্যদিকে প্রবাসীদের অধিকার রক্ষায় কার্যকর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

অভিবাসীদের রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। অথচ সেই প্রবাসীরা বিদেশের মাটিতে প্রতিনিয়ত জীবন-ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা ও অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন। মানবিক ও ন্যায্য শ্রমনীতি নিশ্চিত না হলে এই সংকট শুধু অব্যাহতই থাকবে না, বরং আরও গভীর হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















