অটিজম নিয়ে আলোচনা নতুন নয়, তবে এটি নিয়ে বিভ্রান্তি এবং ভুল ধারণা এখনও বহুল প্রচলিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি অটিজমকে “ভয়াবহ সংকট” হিসেবে উল্লেখ করে এর বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি এমনকি দাবি করেন, অটিজম প্রায় পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারণা বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: ইসাবেলের কাহিনি
লেখক রয় রিচার্ড গ্রিঙ্কার নিজের মেয়ের অভিজ্ঞতা থেকে অটিজমের জটিলতা ব্যাখ্যা করেন। ১৯৯২ সালে যখন তাঁর মেয়ে ইসাবেল মাত্র দেড় বছরের, তিনি নাম ডাকলেও সাড়া দিত না, কিংবা পরিবারের দিকে তাকাত না। কিন্তু তখন এসবকে অসাধারণ মনোযোগের নিদর্শন ভেবে তিনি বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছিলেন।
দুই বছর ছয় মাস বয়সে ইসাবেলের যে নির্ণয় হয়েছিল, সেটি ছিল “পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার–নট আদারওয়াইজ স্পেসিফাইড (পিডিডি-এনওএস)”, যা এখন অচল একটি শব্দ। চিকিৎসকরা তখন সরাসরি “অটিজম” বলতে ভয় পেতেন, কারণ এটি পরিবারকে ভয় ও হতাশায় ফেলে দিতে পারত।
অটিজম: অতীত থেকে বর্তমান
অটিজমকে একসময় বিরল রোগ মনে করা হতো। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে চিকিৎসকরা এটি স্কিজোফ্রেনিয়া থেকে আলাদা করতে শুরু করেন। একই সময়ে ব্রুনো বেটেলহেইম নামের প্রভাবশালী লেখক মায়েদের দোষারোপ করেন, দাবি করেন “ঠান্ডা মা’র” কারণে অটিজম হয়। এর ফলে বহু শিশু মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জন প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়।

১৯৯৮ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক অ্যান্ড্রু ওয়েকফিল্ড একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যেখানে তিনি টিকা গ্রহণকে অটিজমের কারণ হিসেবে দেখান। পরে প্রমাণিত হয় তিনি তথ্য বিকৃত করেছিলেন। প্রবন্ধ প্রত্যাহার করা হলেও “টিকা অটিজম সৃষ্টি করে” এই মিথ আজও টিকে আছে।
অটিজম ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি
বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, টিকা নয় বরং অটিজমের সঙ্গে জড়িত ১০০-রও বেশি জিন রয়েছে। এগুলো পরিবেশ ও জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে ভিন্ন ভিন্ন রূপ তৈরি করে। তাই বিশেষজ্ঞরা এখন বলেন, “অটিজম” নয় বরং “অটিজমগুলো” আছে।
ডিএসএম-এর বিভিন্ন সংস্করণে সংজ্ঞা পরিবর্তনের ফলে অটিজমের পরিধি ক্রমে বেড়েছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণে “অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার” নামে একটিমাত্র ছাতার নিচে সব ধরনকে আনা হয়েছে। এর মধ্যে এমন মানুষও আছেন যারা কথা বলতে পারেন না এবং সার্বক্ষণিক সহায়তা প্রয়োজন, আবার এমনও আছেন যারা একাডেমিক বা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অসাধারণ সফল।
সমাজ, সংস্কৃতি ও ভুল ধারণা
অটিজম সব সময় এক রকমভাবে দেখা হয়নি। নাভাহো উপজাতিরা একে “বিকাশের একটি ধাপ” হিসেবে দেখেছে, আবার সাহারা-উপসাহারীয় আফ্রিকার কোথাও এটি আত্মা ভর করার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ইসরায়েলের কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী একে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষমতা মনে করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের ভুলভাবে “আচরণগত সমস্যা” হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, অথচ শ্বেতাঙ্গ শিশুদের একই লক্ষণকে অটিজম হিসেবে ধরা হয়েছে। এতে সঠিক চিকিৎসা ও শিক্ষাসেবা পাওয়ার সুযোগ বঞ্চিত হয়েছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এখন এ বৈষম্য কমছে।
অটিজমের হারের উত্থান: আসল কারণ
ট্রাম্প দাবি করেছেন ২০০০ সাল থেকে অটিজমের হার ৪০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি মূলত সংজ্ঞার পরিবর্তন ও সচেতনতার কারণে। আগে যাদের মানসিক প্রতিবন্ধকতা বা শেখার সমস্যায় আক্রান্ত বলা হতো, তাদের অনেককেই এখন অটিজমের আওতায় আনা হচ্ছে।
নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণার প্রয়োজন
অটিজম নিয়ে অনেক স্বপক্ষসমর্থকরা মনে করেন এটি মোটেও রোগ নয়, বরং মানুষের ভিন্নরকম অস্তিত্ব। অন্যদিকে কেউ কেউ বলেন, গুরুতর সমস্যা যেমন খিঁচুনি, বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা বা আত্মক্ষতি—এসব যেন ভুলে না যাওয়া হয়। এজন্য “প্রফাউন্ড অটিজম” নামে আলাদা শ্রেণিবিন্যাস প্রস্তাব করা হচ্ছে।
গবেষকদের মতে, অটিজম কেবল শৈশবের বিষয় নয়। প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে কীভাবে অটিজমের সঙ্গে মানুষ পরিবর্তিত হয় এবং কোন ধরনের সেবা তাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে, এ নিয়ে আরও গবেষণা জরুরি।

অটিজম বোঝার ইতিহাস আমাদের শেখায়—এটি কোনো সহজ উত্তর বা একক কারণের বিষয় নয়। বিজ্ঞান ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়, আর সামাজিক উপলব্ধি বদলায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অটিজম আক্রান্ত মানুষদের অভিজ্ঞতা ও কণ্ঠস্বরকে নীতি ও আলোচনার কেন্দ্রে রাখা।
লেখকের মেয়ে ইসাবেল আজ সুখী ও সক্রিয় জীবনযাপন করছেন। তাঁর কাছে অটিজম মানে নিখুঁত সুর শনাক্ত করার ক্ষমতা, জটিল ধাঁধা সমাধান করা, এবং নিজস্ব রসবোধে অন্যকে আনন্দ দেওয়া।
আমরা অনেক দূর এগিয়েছি—এখন আর সেই সময়ে ফেরা যাবে না, যখন অটিজমকে শুধু অভাবের দৃষ্টিতে দেখা হতো, মায়েদের দোষারোপ করা হতো, এবং আক্রান্তদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখা হতো।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















