এআই দিয়ে ভবিষ্যৎ ঝুঁকি শনাক্তের উদ্যোগ
আগামী বছরগুলোতে একজন নারীর স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কতটা — এবার হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) জানিয়ে দিতে পারবে সেই উত্তর। গবেষক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমন এআই মডেল তৈরি করছে, যা স্তন ক্যানসারের পাশাপাশি ফুসফুস ক্যানসার ও অন্যান্য রোগের ঝুঁকিও পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হবে।
বর্তমানে ম্যামোগ্রাম ব্যবহার করে এআই অ্যালগরিদমকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এতে অতীতের সেই রোগীদের তথ্য রাখা হয়েছে, যাদের পরবর্তীতে স্তন ক্যানসার হয়েছিল। ফলে চোখে দেখা দেওয়ার আগেই এআই ঝুঁকি শনাক্ত করতে শিখছে।
ক্লিনিকে আসছে নতুন এআই টুল
ক্ল্যারিটি (Clairity) ও ডিপহেলথ (DeepHealth) নামের দুটি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এ ধরনের এআই অ্যালগরিদম আনতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এভাবে চিকিৎসাক্ষেত্রে এআইকে শুধু সহায়ক নয়, বরং ঝুঁকি নির্ধারণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ব্যবহারের পথ খুলছে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের রেডিওলজির অধ্যাপক ও ক্ল্যারিটির প্রতিষ্ঠাতা ডা. কনি লেহম্যান বলেন, “একজন নারীর পাঁচ বছরের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি ম্যামোগ্রাম দেখে আমরা অনুমান করতে পারি না। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে মানুষ সক্ষম নয়, কিন্তু এআই তা করতে পারছে।”

ক্ল্যারিটির এআই মডেল প্রশিক্ষিত হয়েছে ৪ লাখেরও বেশি রুটিন ম্যামোগ্রামের ওপর যেখানে পাঁচ বছর পরের ক্যানসার-স্থিতিও যুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্তন টিস্যুর এমন সূক্ষ্ম প্যাটার্ন এআই চিহ্নিত করেছে, যা মানুষের পক্ষে আলাদা করা সম্ভব নয়।
নারীর জীবনচিহ্নও জানায় এআই
পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে, এআই শুধু ক্যানসারের ঝুঁকি নয়, নারীর বয়স, মেনোপজের অবস্থা কিংবা সন্তান জন্ম দিয়েছেন কিনা — এসব তথ্যও ম্যামোগ্রাম থেকে অনুমান করতে পারে। এ বছরের মে মাসে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (FDA) ক্ল্যারিটির এআইকে অনুমোদন দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এ বছরই ক্লিনিকে তা চালু করার পরিকল্পনা করছে এবং বীমা কভারেজ নিয়েও আলোচনা করছে।
পুরনো ক্যালকুলেটরের চেয়ে কার্যকর
বর্তমানে ব্যবহৃত ঝুঁকি নির্ধারণের পদ্ধতি তুলনামূলক কম উন্নত। নারীর বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, স্তনের ঘনত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে ঝুঁকি ক্যালকুলেটর কাজ করে। ৫ বছরের ঝুঁকি যদি ৩ শতাংশ বা আজীবনের ঝুঁকি যদি ২০ শতাংশ ছাড়ায়, তবে তাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।
তবে নতুন এআই মডেল এসব পুরনো ক্যালকুলেটরের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভুল। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত ক্যালকুলেটর প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিক ঝুঁকি নির্ধারণ করে, আর এআই তা ৭০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে করতে পারে।

পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ও চিকিৎসার নতুন দিগন্ত
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের গবেষক ডা. গ্রাহাম কোল্ডিটজ এআই ভিত্তিক একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এতে নারীদের পাঁচ বছরের ঝুঁকি নির্ধারণ করে তাদের ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী বেশি বা কম স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা হবে।
উচ্চ ঝুঁকির নারীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত এমআরআই, বিশেষ ওষুধ (যেমন টামোক্সিফেন) ব্যবহার করে রোগের সম্ভাবনা কমানো সম্ভব। অন্যদিকে, কম ঝুঁকির নারীদের ক্ষেত্রে স্ক্রিনিং কমানো যাবে। এতে প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি ব্যক্তিনির্ভর ও কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সতর্কতা ও বিতর্ক
তবে অনেক চিকিৎসক এখনো সতর্ক অবস্থানে আছেন। তাঁদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে এ প্রযুক্তি মৃত্যুহার কমায় কিনা, সেই প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এটি হয়তো এমন সব টিউমার শনাক্ত করবে যেগুলো আসলে ক্ষতিকর নয়।
আমেরিকান কলেজ অব রেডিওলজির ব্রেস্ট ইমেজিং কমিশনের চেয়ারম্যান ডা. স্টামাটিয়া ডেস্টুনিস বলেন, “এটি দারুণ এক উদ্যোগ, কিন্তু এখনো এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার সময় আসেনি। মৃত্যুহার কমছে কিনা, সে বিষয়ে তথ্য নেই।”
বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীতে কার্যকারিতা
কিছু চিকিৎসকের আশঙ্কা, ভিন্ন জনগোষ্ঠীতে এআই হয়তো সমানভাবে কার্যকর হবে না। তবে নতুন তথ্য বলছে, ‘সাইবিল’ নামের একটি এআই মডেল ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি নির্ধারণে আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নির্ভুল ফল দিয়েছে।
এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের রোগীদের ডেটাতেও এটি সফলভাবে কাজ করেছে। ফলে চিকিৎসকরা বিশ্বাস করছেন, ধূমপানের ইতিহাস ছাড়াও এআই অন্যান্য উপাদান দিয়ে ঝুঁকি শনাক্ত করতে পারবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
স্তন ও ফুসফুস ক্যানসারের বাইরে, কিডনি রোগ বা জেনেটিক মিউটেশনজনিত অন্যান্য রোগের ঝুঁকি পূর্বাভাসেও এআই নিয়ে কাজ চলছে। ডিপহেলথ ইতোমধ্যে ইউরোপে তাদের এআই ঝুঁকি নির্ধারণ ব্যবস্থা চালু করেছে এবং তারা চেষ্টা করছে একটি মাত্র ম্যামোগ্রাম দিয়েই ক্যানসারের পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকিও বের করে আনা যায় কিনা।
ডিপহেলথের কর্মকর্তা ডা. নিকোলো স্টেফানি বলেন, “একই পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকিও যদি জানা যায়, তবে রোগীরা দ্বিগুণ উপকার পাবেন।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















