পাঁচ বছর ধরে আগ্রাসী বৈশ্বিক সম্প্রসারণের পর চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ ধীর হতে শুরু করেছে। ব্যাটারি ও কাঁচামালের মতো পুঁজি-নিবিড় প্রকল্পগুলো ২০২৩ সালে শীর্ষে পৌঁছায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানিগুলো কম খরচে গাড়ি সংযোজন কারখানা তৈরির দিকে ঝুঁকছে।
২০২৪ সালে চীনা কোম্পানিগুলো ইভি ও সংশ্লিষ্ট খাতে মোট ১৪৪টি লেনদেন ঘোষণা করে, যার মূল্য দাঁড়ায় ১৯.৬ বিলিয়ন ডলার—আগের বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ৬৪টি লেনদেনের ঘোষণা আসে, যার মূল্য ১০.৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি গেছে নিম্ন ধাপের কারখানার দিকে।
ইউরোপে ধীরগতি, মার্কিন বাজারে বাধা
রোডিয়াম গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক আর্মান্ড মেয়ার জানিয়েছেন, ইউরোপে অধিকাংশ পরিকল্পনা থাকলেও বর্তমানে তা অনেকটা থমকে গেছে এবং বেশ কিছু প্রকল্প বাতিল হয়েছে। একইসঙ্গে মার্কিন বাজার কার্যত চীনা ইভি কোম্পানিগুলোর জন্য বন্ধ।
তবে ধীরগতির মাঝেও বিদেশি বিনিয়োগ দেশীয় বিনিয়োগের চেয়ে এগিয়ে থাকবে বলে মনে করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে গত বছর থেকে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে পুনরুদ্ধার শুরু হয়।
চীনা কোম্পানির অবস্থান
চীনের মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের এক-চতুর্থাংশ গত বছর গেছে ইভি খাতে, যা ২০২১ সালের মাত্র ৫ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। ব্যাটারি নির্মাতা CATL, BYD এবং Envision গত ১১ বছরে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী ছিল, যার বড় অংশই ইউরোপে গেছে।
তবে অনিশ্চিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। চীনের অভ্যন্তরে তীব্র মূল্যযুদ্ধের কারণে বিদেশি বাজার এখনও বেশি লাভজনক থাকছে বলে কোম্পানিগুলো জানাচ্ছে। অনেকে প্রযুক্তি লাইসেন্স দিয়ে স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে উৎপাদনের দিকেও ভাবছে।
এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ঝোঁক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সুরক্ষাবাদী বাণিজ্যনীতির ফলে চীনা কোম্পানিগুলো সরবরাহ চেইন চীনের বাইরে সরাতে শুরু করেছে। এতদিন ইউরোপ ছিল সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী, কিন্তু এখন বিনিয়োগ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দিকে সরে যাচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়া বড় বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে, কারণ দেশটিতে নিকেলের মতো প্রচুর কাঁচামাল রয়েছে। অনেক নিকেল খনি চীনা মালিকানায়, এবং হুয়ায়ো কোবাল্ট এ বছর একটি বড় ব্যাটারি প্রকল্পে কৌশলগত অংশীদার হয়েছে। সেখানে শুধু ব্যাটারি উৎপাদন নয়, ইভি অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট গড়ার পরিকল্পনাও চলছে।
অতিরিক্ত উৎপাদন ও প্রতিযোগিতা
২০২১ ও ২০২২ সালের দেশীয় বিনিয়োগে চীনে যে ব্যাটারি উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, তা স্থানীয় চাহিদার দ্বিগুণ এবং বৈশ্বিক চাহিদারও ১.২ গুণ। ফলে বর্তমানে অতিরিক্ত উৎপাদন ও মূল্যযুদ্ধ নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন। এজন্য কর্তৃপক্ষ BYD ও Trina Solar-এর মতো কোম্পানিগুলোকে ডেকে ‘অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা’ বা ‘ইনভল্যুশন’ সমস্যার সমাধানে আলোচনা করেছে।
রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও প্রযুক্তি সীমাবদ্ধতা
চীনা সরকার সম্প্রতি বিদেশে বিনিয়োগ কঠিন করে তুলেছে। জুলাইয়ে ব্যাটারি ক্যাথোড প্রযুক্তির জন্য নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, যা দেশের বাইরে ব্যবহার করতে হলে সরকারি অনুমোদন লাগবে। এর আগে ডিসেম্বর মাসে বিরল-ধাতব চুম্বক প্রযুক্তি রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
বিশ্লেষকদের ধারণা, চীনা কোম্পানিগুলো হয়তো বিদেশি কারখানায় এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে, তবে প্রতিদ্বন্দ্বী বিদেশি কোম্পানির কাছে তা লাইসেন্স দেওয়া হবে না।
মার্কিন বাজারে চ্যালেঞ্জ
মার্কিন সরকারের কঠোর নীতির কারণে সেখানে বিনিয়োগ খুবই সীমিত রয়ে গেছে। চীনা ব্যাটারি নির্মাতাদের ওপর কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে এবং তাদের গাড়ি কার্যত মার্কিন বাজার থেকে বাদ পড়েছে।
পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে বৈদেশিক সম্প্রসারণ
বিদেশে ইভি ও ব্যাটারি শিল্পে চীনের আগ্রাসী বিনিয়োগ আসলে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি খাতে বড় ধাক্কার অংশ। করোনার আগে সৌরশক্তি শিল্পে বেশি বিনিয়োগ হতো, কিন্তু ২০২২ থেকে ব্যাটারি ও ইভি খাতে তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে সামগ্রিকভাবে বিদেশে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি বিনিয়োগ ধীর হয়েছে। নতুন শুল্কনীতি ও কঠোর উৎপত্তি নিয়মের কারণে কোম্পানিগুলো এখন কম ঝুঁকির “হালকা সম্পদভিত্তিক কৌশল” নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তি লাইসেন্স দেওয়া, চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন এবং মূল যন্ত্রাংশ নির্মাতাদের (OEM) সঙ্গে চুক্তি—যা বড় বিনিয়োগ ছাড়াই বাজারে প্রবেশের পথ খুলে দিচ্ছে।