নতুন আদেশের প্রেক্ষাপট
ভারতের সরকার ২০২৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ফরেনার্স (এক্সেম্পশন) অর্ডার জারি করেছে। এই আদেশ মূলত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে প্রণীত হলেও নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়েছে। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান শরণার্থীরা—যারা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে প্রবেশ করেছে—তারা এ সুবিধা পাবেন।
কিন্তু মুসলিমরা এই আইনের বাইরে রাখা হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি মুসলিমরা এখন “অবৈধ অভিবাসী” হিসেবে গণ্য হবেন এবং তাদের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ রুপি জরিমানা ও নির্বাসনের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
বিশেষ ছাড়প্রাপ্ত গোষ্ঠী
আদেশে যাদের বৈধ নথি না থাকলেও মানবিক কারণে ভারতে থাকতে দেওয়া হবে:
- নেপাল ও ভুটানের নাগরিকরা
- ২০০৩ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করা তিব্বতি শরণার্থীরা
- ২০১৫ সালের আগে আসা শ্রীলঙ্কার তামিল শরণার্থীরা
- তিন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে আসা ছয়টি অমুসলিম সম্প্রদায়
সমালোচনা ও বিতর্ক
আইনজীবী পূরবি প্যাটেল প্রশ্ন তুলেছেন: “কিছু গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিয়ে অন্যদের বাদ দেওয়ার যুক্তি কোথায়?”
সরকারি যুক্তি হলো, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে অমুসলিম সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়, তাই তাদের প্রমাণ দিতে হবে না। বিজেপি নেতা মোহিত রায় বলেন, “মুসলিমরা নিপীড়নের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই তাদের এই ছাড় দেওয়া হয়নি।”
সমালোচকরা বলছেন, এই আইন মুসলিম অভিবাসীদের ওপর পরিকল্পিত নিপীড়নকে বৈধতা দিচ্ছে। দিল্লির আইনজীবী উজ্জয়িনী চ্যাটার্জি মন্তব্য করেছেন, “এই নীতি আসলে মুসলিম শরণার্থীদের লক্ষ্য করে তৈরি।”
পূর্ববর্তী আইন ও নতুন প্রবণতা
২০১৯ সালে মোদী সরকার সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (CAA) পাস করেছিল, যেখানে একই ছয়টি অমুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য নাগরিকত্বের পথ খোলা হয়েছিল, তবে শর্ত ছিল তারা ২০১৪ সালের আগে আসতে হবে। সেই সময় দেশজুড়ে বড় আন্দোলন হয়েছিল, কারণ আইনটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে আঘাত করে।
এপ্রিল ২০২৫-এ নতুন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ফরেনার্স অ্যাক্ট পাস হয়, যেখানে শাস্তি বাড়ানো, নজরদারি কড়াকড়ি এবং নির্বাসন সহজ করার বিধান আনা হয়। সমালোচকরা বলছেন, এসব আইন রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অপ্রিয় গোষ্ঠীকে বাদ দেওয়ার হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযান
মে ২০২৫ থেকেই সরকার অভিযান জোরদার করেছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মুসলিম ও রোহিঙ্গাদের গ্রেপ্তার ও বহিষ্কার শুরু হয়। মহারাষ্ট্র, আসাম, গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, ওড়িশা ও দিল্লি থেকে কয়েক হাজার মানুষ আটক হয়েছেন।
মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনেক রোহিঙ্গাকে সমুদ্রপথে জোর করে মিয়ানমারের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দুই হাজারের বেশি মুসলিম, যার মধ্যে শতাধিক রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে বহিষ্কৃত হয়েছে। এমনকি কিছু ভারতীয় মুসলিম নাগরিককেও ভুলভাবে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ অনেক সময় শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলা বা লুঙ্গি পরাকে “বাংলাদেশি” হওয়ার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে সাধারণ গরিব পরিবারগুলো প্রমাণপত্র দেখাতে না পারায় হয়রানির শিকার হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ইলেন পিয়ারসন বলেছেন, “বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের নির্বিচারে বহিষ্কার করে বিজেপি বৈষম্য ছড়াচ্ছে।”
শ্রীলঙ্কার তামিলদের অনিশ্চয়তা
শ্রীলঙ্কার তামিল শরণার্থীরা ভারতে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে শিবিরে বসবাস করছে। নতুন আদেশে ২০১৫ সালের আগে যারা এসেছেন তাদের বহিষ্কার থেকে রক্ষা করা হলেও নাগরিকত্বের কোনো পথ খোলা হয়নি।
তামিলনাডুর সরকার দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দেওয়ার সুপারিশ করলেও কেন্দ্রীয় সরকার তা উপেক্ষা করেছে। ফলে হাজারো তামিল শরণার্থী ও তাদের সন্তানরা এখনো রাষ্ট্রহীন অবস্থায় রয়েছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রভাব
বিজেপি নেতারা বলছেন, এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য মুসলিম অভিবাসন ঠেকানো। মোহিত রায় স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “মুসলিমরা ভারতের নাগরিক হতে পারে না।” সমালোচকরা মনে করেন, এটি ভারতীয় সংবিধানের ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতিকে ক্ষুণ্ণ করছে।
ভারতের নতুন শরণার্থী নীতি একদিকে কিছু ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে সুরক্ষা দিলেও অন্যদিকে মুসলিমদের জন্য নিপীড়ন, অনিশ্চয়তা ও নির্বাসনের পথ প্রশস্ত করছে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ছে, এবং বিশেষ করে দরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলো ভয় ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
এই আইন শুধুমাত্র মানবিক প্রশ্ন নয়, বরং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছে।