শরৎ মানেই নীল আকাশ, সাদা মেঘ, কাশফুলের দোল। কলকাতায় দুর্গাপূজার আগে এই আবহাওয়া শহরবাসীর কাছে আনন্দের আরেক নাম। কিন্তু এবারের দৃশ্য ভিন্ন। টানা দু’দিনের প্রবল বর্ষণে কলকাতা কার্যত জলমগ্ন। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত শহরে গড়ে ১৮০–২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া দপ্তর। আজও সকাল থেকে থামেনি ফোঁটা–ফোঁটা বৃষ্টি। এর ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন লাখো মানুষ, ব্যাহত হয়েছে পূজার প্রস্তুতি। তবুও শহরজুড়ে বিরামহীন ভিজে সুরের ভেতর ঢাকের আওয়াজই শোনাচ্ছে—“দেবী আসছেন।”
বৃষ্টির তাণ্ডব: সংখ্যার হিসাব
আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী—
- রবিবার রাত থেকে সোমবার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে প্রায়১১০ মিলিমিটার।
- সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আবারও নেমেছে প্রায়৭০–৮০ মিলিমিটার।
- দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়া,টালিগঞ্জ, কসবা এলাকায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে, যেখানে এক দিনে প্রায় ১২০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে।
এই বৃষ্টির কারণে শহরের বহু সড়ক জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। অনেক এলাকায় কোমর সমান জল জমায় যানবাহন বন্ধ হয়ে যায়, বাস-ট্যাক্সি মাঝরাস্তায় আটকে পড়ে।
ডুবে যাওয়া রাস্তাঘাট
কলকাতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা কার্যত নদীর চেহারা নিয়েছে।
- এক্সাইড মোড় ও ময়দান এলাকা:সকাল থেকে যানবাহন চলাচল ছিল অচল।
- শিয়ালদহ ফ্লাইওভারের নিচ:ট্যাক্সি, অটো দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়।
- বালিগঞ্জ স্টেশন রোড:হাঁটু–সমান জল জমে, রিকশা চলাচল প্রায় বন্ধ।
- সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার,ধর্মতলা ও চিতপুর রোড: পথচারীদের বুক সমান পানিতে চলতে দেখা গেছে।
- কসবা,মানিকতলা ও গড়িয়া: গলির ভেতর জল জমায় অনেক পরিবার ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে।
শহরের পুরসভা জানিয়েছে, শুধু সোমবারেই প্রায় ৪০টিরও বেশি এলাকায় জল জমে গেছে, যার মধ্যে অন্তত ১৫টি এলাকা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
পূজার প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত
দুর্গাপূজার এক সপ্তাহ বাকি থাকতেই শহরের শিল্পীরা পড়েছেন বিপাকে।
- শোভাবাজার রাজবাড়ি,বাগবাজার, হাতিবাগান ও লেকটাউন এলাকার ঐতিহ্যবাহী পূজায় মণ্ডপের ভেতর ঢুকে পড়েছে জল।
- অন্তত২৫টির বেশি বড় মণ্ডপে কাঠামো ভিজে গেছে, অনেক জায়গায় প্রতিমার রঙ উঠে গেছে।
- মণ্ডপশিল্পীরা ভিজে কাঠামো শুকিয়ে আবার নতুন করে রঙ তুলতে বাধ্য হচ্ছেন।
একজন শিল্পী জানালেন—
“টানা বৃষ্টিতে আমাদের কয়েকদিনের কাজ নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু দেবীকে স্বাগত জানানোর আনন্দে আবারও আমরা নতুন করে রঙ তুলছি।”
সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ
দু’দিনের টানা বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিসযাত্রীরা। সোমবার সকালে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে-তে প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা যানজট তৈরি হয়। শিয়ালদহ থেকে গড়িয়াহাটগামী বাস মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়, যাত্রীরা হাঁটতে বাধ্য হন।
শহরের বাজার-ঘাটেও ভিজে গেছে পূজার আবহ। নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট ও হাতিবাগানে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে অর্ধেকেরও বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পূজার আগে যেখানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, সেখানে এ বছর দোকান ফাঁকা পড়ে আছে।
মানুষের বিশ্বাস
তবে সব বিপত্তির মাঝেও কলকাতার মানুষ ভেঙে পড়েনি। ভিজে শাড়ি, কাদামাখা জুতো—এসবের মাঝেই মানুষ বলছে, পূজার আনন্দ বৃষ্টি আটকাতে পারবে না।
এক তরুণীর মন্তব্য—
“এই শহরে দেবী আসেন বৃষ্টির ভেতর দিয়েই। জল জমুক, আলো নিভুক—আমাদের বিশ্বাসে কোনো দাগ লাগে না।”
কলকাতার শরৎ এখন এক অচেনা ছবি—ভিজে রাস্তা, ডুবে যাওয়া মোড়, থেমে থাকা যানবাহন। কিন্তু এই ভিজে চিত্রও ঢেকে রাখতে পারছে না পূজার আগমনী উচ্ছ্বাস। শহরের প্রতিটি অলি-গলি, প্রতিটি ঢাকের আওয়াজ বলছে—
“মেঘভাঙা বৃষ্টি শুধু শহরকে ভিজিয়েছে, পূজার আনন্দকে নয়।”