ভারত সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষের (ISA) সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে দেশটি কার্লসবার্গ রিজ এলাকায় পলিমেটালিক সালফাইডস (PMS) অনুসন্ধানের একচেটিয়া অধিকার লাভ করেছে। এর ফলে ভারত এখন বিশ্বের একমাত্র দেশ, যাদের দুটি PMS অনুসন্ধান চুক্তি রয়েছে। এই অর্জন শুধু বৈজ্ঞানিক দিক থেকে নয়, কৌশলগত গুরুত্বের দিক থেকেও বড় মাইলফলক।
নতুন চুক্তি ও অনুসন্ধানের পরিকল্পনা
গোয়া-ভিত্তিক ন্যাশনাল সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড ওশান রিসার্চ (NCPOR) ২০২৬ সাল থেকে এই অনুসন্ধান শুরু করবে। প্রথমে ভূ-ভৌতিক ও জল-সমীক্ষা চালানো হবে। ২০২৪ সালে ভারত ISA-তে আবেদন করেছিল এবং মূল্যায়নের পর সংস্থাটি কার্লসবার্গ রিজে প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বরাদ্দ করে।
এর আগে, ২০১৬ সালে ভারত মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরের রিজ এলাকায় PMS অনুসন্ধানের আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
পলিমেটালিক সালফাইডস (PMS) কী এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ
পলিমেটালিক সালফাইডস সমুদ্রতলের খনিজ স্তর, যা তামা, দস্তা, সিসা, সোনা, রুপা এবং কিছু দুর্লভ ধাতুতে সমৃদ্ধ। এসব ধাতু আধুনিক প্রযুক্তি, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবস্থা এবং সবুজ প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য।
স্থলভাগে এসব ধাতুর প্রাপ্যতা সীমিত হওয়ায় গভীর সমুদ্রে PMS অনুসন্ধান ভারতের সম্পদ নিরাপত্তা বাড়াতে সহায়ক হবে। সাধারণত এসব খনিজ হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট বা সমুদ্রতলের উষ্ণ প্রস্রবণের কাছে পাওয়া যায়। সমুদ্রতলের ফাটল দিয়ে সমুদ্রের ঠান্ডা জল ভূত্বকের মাগমার সঙ্গে মিশে উত্তপ্ত হয়ে খনিজ সমৃদ্ধ জলে পরিণত হয়, যা পরে সমুদ্রতলে জমা পড়ে।

আগের অভিজ্ঞতা ও নতুন প্রযুক্তি
২০১৬ সালের চুক্তির পর থেকে NCPOR মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরের রিজ এলাকায় জরিপ চালিয়ে আসছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি আধুনিক অবকাঠামো ও বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছে।
সরকারের চলমান ‘ডিপ ওশান মিশন’ এই সক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে। এতে নতুন সমুদ্রগামী জাহাজ, স্বয়ংক্রিয় আন্ডারওয়াটার ভেহিকল (AUV), এবং ‘সমুদ্রায়ান’ মিশনের জন্য তৈরি হওয়া গভীর সমুদ্রযান ‘মৎস্য 6000’ অন্তর্ভুক্ত।
NCPOR-এর অনুসন্ধান পরিকল্পনা তিন ধাপে বিভক্ত:
- প্রথম ধাপ: জাহাজ-নির্ভর যন্ত্র দিয়ে প্রাথমিক জরিপ চালানো ও সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত করা।
- দ্বিতীয় ধাপ: AUV ও রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকল (ROV) দিয়ে সমুদ্রতলের কাছে বিস্তারিত জরিপ করে খনিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
- তৃতীয় ধাপ: চিহ্নিত খনিজ ভাণ্ডারের সম্পদ মূল্যায়ন করা।

কার্লসবার্গ রিজের গুরুত্ব
কার্লসবার্গ রিজ ভারত মহাসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্য-সমুদ্র রিজ, যা ভারতীয় প্লেট ও সোমালি প্লেটের বিচ্ছেদে গঠিত। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪ কোটি বছর আগে এটি গঠন শুরু হয় এবং বর্তমানে এর বিস্তারের হার গড়ে ২.৪ থেকে ৩.৩ সেন্টিমিটার প্রতি বছর।
এই রিজে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট সিস্টেম রয়েছে, যা গত তিন দশক ধরে ভারত বৈজ্ঞানিকভাবে অধ্যয়ন করছে। কৌশলগতভাবে এর অবস্থান ভারতের কাছাকাছি (প্রায় ২° উত্তর অক্ষাংশে), যেখানে আগের রিজ এলাকাগুলো ভারতের অনেক দক্ষিণে অবস্থিত।
PMS অনুসন্ধানের জটিলতা
PMS অনুসন্ধান অন্যান্য খনিজ অনুসন্ধানের তুলনায় প্রযুক্তিগতভাবে বেশি জটিল। এগুলো সাধারণত ২,০০০ থেকে ৫,০০০ মিটার গভীরে কঠিন ও অসমতল পাথুরে এলাকায় পাওয়া যায়, যা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চলের মধ্যে একটি।
এ কারণে উন্নত নেভিগেশন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, ডাইনামিক পজিশনিং ক্ষমতাসম্পন্ন গভীর সমুদ্রযান প্রয়োজন হয়। এছাড়া সমুদ্র ভূতত্ত্ব, ভূ-ভৌতিক বিজ্ঞান ও গভীর সমুদ্র প্রযুক্তিতে বিশেষজ্ঞ বহুমুখী দল অপরিহার্য।

আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষ (ISA)-এর ভূমিকা
ISA জাতিসংঘের সমুদ্র আইন কনভেনশনের (UNCLOS) আওতায় আন্তর্জাতিক জলসীমায় খনিজ অনুসন্ধানের অধিকার বরাদ্দ করে। কোনো দেশ সরকার, সরকারি সংস্থা বা অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবেদন করতে পারে।
আবেদনে অনুসন্ধান এলাকা, বিস্তারিত পরিকল্পনা, পরিবেশগত ভিত্তি তথ্য এবং আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার নথি থাকতে হয়। ISA-এর লিগ্যাল ও টেকনিক্যাল কমিশন তা পর্যালোচনা করে অনুমোদনের সুপারিশ করে।
ভারতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভারত সরকারের ‘ব্লু ইকোনমি’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশটি আরও নতুন সমুদ্রতল এলাকা অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করছে। বিশেষ করে আফানাসি-নিকিতিন সিমাউন্ট অঞ্চলে কোবাল্ট-সমৃদ্ধ ফেরোম্যাঙ্গানিজ স্তর অনুসন্ধানের জন্য ভারত আবেদন করেছে। এই আবেদন বর্তমানে মূল্যায়নের অধীনে রয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















