জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে অ্যানথ্রাক্স একটি জুনোটিক রোগ—অর্থাৎ, পশু থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে এমন সংক্রমণ। রোগটির নাম শুনলেই অনেকের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়, কারণ এটি একেবারেই সাধারণ রোগ নয়। বিশেষ করে যেখানে গবাদি পশু পালন ব্যাপক এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা কম থাকলে, সেখানে অ্যানথ্রাক্স একটি স্থায়ী ও গোপন বিপদ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে একাধিকবার এ রোগ প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ২০০৯–২০১০ সালের দিকে দেশজুড়ে বিস্তৃত অ্যানথ্রাক্স প্রাদুর্ভাব একটি বড় সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়ায়।
ইতিহাস ও প্রাদুর্ভাব: বাংলাদেশের পটভূমি
- ১৯৮০–১৯৮৪ সালের মধ্যে গবাদি পশু ও মানুষের মধ্যে অ্যানথ্রাক্সের কিছু ঘটনা প্রচলিত ছিল।
- ২০০৯–২০১০ সালে এটি পুনরায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১০ সালে ১২টি জেলায় ৬০০-র বেশি মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়।
- গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর—বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বর্ষার শুরুতে—উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু জেলা যেমন সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল অ্যানথ্রাক্স প্রাদুর্ভাবের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
- ঐসব অঞ্চলের মাটির নমুনায় অ্যানথ্রাক্স স্পোর পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত দেয় রোগটি কেবল পশু সংক্রমণ নয়, বরং মাটিতে দীর্ঘ সময় গুপ্ত অবস্থায় টিকে থাকতে পারে।
অতএব, অ্যানথ্রাক্স কেবল একটি একক রোগ নয়, বরং পরিবেশ ও কৃষিভিত্তিক একটি অন্তর্নিহিত সমস্যা।
কারণ ও সংক্রমণের পথ
স্পোর ও জীবনচক্র
অ্যানথ্রাক্স সৃষ্টি করে Bacillus anthracis নামের এক ব্যাকটেরিয়া। এটি “স্পোর” আকারে বহু বছর কঠিন পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। সংক্রমিত পশুর মৃতদেহ বা তাদের বর্জ্য থেকে মাটি, গবাদি পশুর খাদ্য বা জল দূষিত হয় এবং সেখান থেকেই নতুন সংক্রমণ শুরু হয়।
মানুষের সংক্রমণের প্রধান পথ
মানুষে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ তিনভাবে হয়ে থাকে:
- ত্বকের মাধ্যমে (Cutaneous): সংক্রমিত পশুর চামড়া, রক্ত, লোম বা মাংস স্পর্শ করলে ক্ষতস্থল দিয়ে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে। এটি সবচেয়ে সাধারণ ও তুলনামূলকভাবে কম মারাত্মক।
- শ্বাসনালীতে (Inhalational): বাতাসে ভেসে থাকা স্পোর ফুসফুসে ঢুকে দ্রুত জটিলতা তৈরি করে। এটি সবচেয়ে ভয়ানক।
- পরিপাকতন্ত্রে (Gastrointestinal/Oropharyngeal): সংক্রমিত বা অপর্যাপ্তভাবে রান্না করা মাংস খেলে এ সংক্রমণ হতে পারে।
বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রধানত ত্বকের মাধ্যমে সংক্রমণ দেখা গেছে। অনেক মানুষ পশু জবাই, চামড়া ছাড়ানো, রক্ত পরিষ্কার বা মাংস কাটার সময় নিয়মিতভাবে ঝুঁকিতে থাকেন। এছাড়া অনেক সময় মৃত পশুর দেহ নদী, খাল বা খোলা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়—এতে পরিবেশ নতুন সংক্রমণের উৎসে পরিণত হয়।
মানুষের দেহে প্রভাব ও উপসর্গ
ক. ত্বকের সংক্রমণ
- শুরুতে ছোট দানা (papule) দেখা দেয়।
- পরবর্তীতে ফোসকা তৈরি হয়ে একটি কালো দাগ বা black eschar হয়, যা এ রোগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- আক্রান্ত স্থানে ফোলা ও ব্যথা দেখা দেয়, অনেক সময় পাশের লসিকাগ্রন্থি ফুলে যায়।
- সাধারণত চিকিৎসা দিলে এটি প্রাণঘাতী হয় না।
খ. শ্বাসনালীর সংক্রমণ
- শুরুতে সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা ও জ্বর দেখা দেয়।
- দ্রুত অবস্থা খারাপ হয়ে যায়—শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে তরল জমা, রক্ত সংক্রমণ এবং শকে আক্রান্ত হতে পারে।
- ২৪–৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর অবস্থা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
গ. পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণ
- গলাভুক্ত হলে গলা ফুলে ওঠা, গলাব্যথা ও গিলতে অসুবিধা হয়।
- অন্ত্র আক্রান্ত হলে পেটব্যথা, বমি, রক্তপাত ও অন্ত্র ফেটে যেতে পারে।
- অনেক ক্ষেত্রেই এ সংক্রমণ প্রাণঘাতী হয়।
ঘ. জটিল সংক্রমণ
রক্তে ছড়িয়ে পড়লে মেনিনজাইটিস বা সেপসিস হতে পারে, যা দ্রুত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।
বাংলাদেশের বাস্তব চ্যালেঞ্জ
নিম্ন টিকাদান কাভারেজ: অনেক এলাকায় গবাদি পশুতে অ্যানথ্রাক্স টিকা প্রয়োগ হয় না বা সীমিতভাবে হয়।
পশুর দেহ ব্যবস্থাপনার অনিয়ম: মৃত পশুর দেহ দাফন বা দাহ না করে খোলা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়, যা সংক্রমণের উৎস তৈরি করে।
পশু-উপাদান ব্যবহারে ঝুঁকি: উল, চামড়া, হাড় ইত্যাদি যদি সংক্রমিত হয়, তবে তা থেকে মানুষে রোগ ছড়াতে পারে।
সচেতনতার অভাব: অনেকেই রোগের ঝুঁকি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানেন না।
চিকিৎসা সুবিধার সীমাবদ্ধতা: প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণ ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ব্যবস্থা অনেক স্থানে দুর্বল।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ
- ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গবাদি পশুকে নিয়মিত ভ্যাকসিন দেওয়া।
- মৃত পশুর সঠিকভাবে দাফন বা দাহ করা।
- গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো।
- পশু জবাই বা মাংস কাটার সময় সুরক্ষামূলক গ্লাভস, মাস্ক ও পোশাক ব্যবহার।
- নিয়মিত নজরদারি ও জরুরি প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- অসুস্থ পশুর মাংস ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।
- ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে মাটির স্পোর পরীক্ষা ও মানচিত্র তৈরি করা।
- জনস্বাস্থ্য ও পশুস্বাস্থ্য খাতে সরকারি সহায়তা ও বাজেট বৃদ্ধি করা।
অ্যানথ্রাক্স শুধু একটি চিকিৎসা বিষয় নয়—এটি কৃষি, জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক সচেতনতার সাথে সম্পর্কিত একটি জটিল চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে যেখানে গবাদি পশু পালন প্রচলিত এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা সীমিত, সেখানে অ্যানথ্রাক্স একটি স্থায়ী বিপদ হয়ে বিদ্যমান।
যে কোনো সময় মাটিতে সুপ্ত স্পোর সক্রিয় হয়ে মানুষ বা পশুকে সংক্রমিত করতে পারে। তবে সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি, দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা ও জনগুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ একত্রে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করলে এই ভয় অনেকাংশে কমানো সম্ভব।