স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ আর দেরি করতে চায় না। ব্যবসায়ী মহলের আশঙ্কা দূর করতে সরকার জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি স্বাধীন মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছে—যা দেশের প্রস্তুতি, সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং ভবিষ্যৎ সক্ষমতা যাচাই করবে।
স্বাধীন মূল্যায়নেই আস্থা খুঁজছে সরকার
বাংলাদেশ সরকার এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া বিলম্বিত না করে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি স্বাধীন মূল্যায়ন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই মূল্যায়নের লক্ষ্য হলো দেশের প্রস্তুতি যাচাই, উত্তরণের পর সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করা এবং আন্তর্জাতিক আস্থা আরও শক্ত করা।
২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের কাছে পাঠানো এক আনুষ্ঠানিক চিঠিতে বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে অনুরোধ জানায়। চিঠিতে এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতি, বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও বহিঃঝুঁকির মূল্যায়নের কথা উল্লেখ করা হয়।

ডিসেম্বরেই আসছে জাতিসংঘের প্রতিবেদন
২৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ বিষয়ক প্রতিনিধি কার্যালয় (UN-OHRLLS) বাংলাদেশের অনুরোধ গ্রহণ করে। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন প্রতিবেদন প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জাতিসংঘের আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল ও পঞ্চম এলডিসি সম্মেলনের মহাসচিব, রাবাব ফাতিমা লেখেন—এই মূল্যায়ন হবে পূর্ণাঙ্গ ও পক্ষপাতহীন, যাতে বাংলাদেশের উত্তরণ প্রক্রিয়া মসৃণ ও টেকসই হয়।
নির্ধারিত সময়: নভেম্বর ২০২৬
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের তারিখ ২৪ নভেম্বর ২০২৬ নির্ধারিত। তবে কিছু ব্যবসায়ী সংগঠন তিন বছরের সময় বৃদ্ধির দাবি তুলেছে। বিএনপি ও জামায়াতের কয়েকজন নেতা সেই দাবিকে সমর্থন করেছেন বলে জানা গেছে।
সরকারি কর্মকর্তারা ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকেই জাতিসংঘের তিনটি মানদণ্ড—প্রতি মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা সূচক—পূরণ করে আসছে। ফলে সময় বাড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম।

ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ, সরকারের আত্মবিশ্বাস
ব্যবসায়ী মহলের কিছু অংশ এখনো আশ্বস্ত না হলেও সরকার বলছে, জাতিসংঘের এই স্বাধীন মূল্যায়নই তাদের উদ্বেগ দূর করবে। ইআরডি আশা করছে ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে।
এদিকে এলডিসি উত্তরণবিষয়ক পরিচালনা কমিটির সভা আগামী ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে, যার সভাপতিত্ব করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এখনই কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আগাম কিছু বললে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি থামিয়ে দিতে পারেন। সরকার উত্তরণে দেরি করবে না; বরং মসৃণ স্থানান্তর প্রক্রিয়ার ওপরই জোর দিচ্ছে।”
অন্তর্ভুক্তিমূলক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া
রাবাব ফাতিমা তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএন-ওএইচআরএলএলএস আনন্দের সঙ্গে এই মূল্যায়ন কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই মূল্যায়ন হবে স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরামর্শভিত্তিক—যেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ এবং উন্নয়ন অংশীদারদের অংশগ্রহণ থাকবে।
এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ইউএন-ওএইচআরএলএলএস-এর পরিচালক রোনাল্ড মোলেরাস, যিনি বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সমন্বয় করে পুরো কাজটি পরিচালনা করবেন।

অক্টোবরের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন
জাতিসংঘ বাংলাদেশকে জানিয়েছে, ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এলডিসি উত্তরণ সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
তাদের মতে, জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিবেদন প্রণয়ন চলছে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে খসড়া সংস্করণ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামতের জন্য পাঠানো হবে।
সময় বৃদ্ধির দাবিতে সরকারের অবস্থান
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, কিছু ব্যবসায়ী সংগঠন সময় বাড়ানোর দাবি তুললেও তা বাস্তবায়ন করা কঠিন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও জাতিসংঘের সঙ্গে সময় বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো আলোচনা করেনি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “আমরা সব মানদণ্ড পূরণ করেছি—তাই বিলম্বের কোনো যৌক্তিকতা নেই। বর্তমান সরকার সময় বাড়ানোর পক্ষে নয়; পরবর্তী নির্বাচিত সরকার চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।”
তিনি আরও বলেন, “গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে প্রণোদনা ও অন্যান্য সুবিধা হিসেবে ১৪ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এসব প্রণোদনা বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণেই ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সময় বাড়ানোর দাবি করছে।”

রপ্তানি সুবিধা নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই
ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারে বাধা সৃষ্টি করবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৯ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা অব্যাহত রাখবে। একইভাবে কানাডা, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও বাণিজ্য সুবিধা বজায় রাখবে।
তাদের মতে, উত্তরণের পর রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা নেই।
বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ এখন কেবল একটি অর্থনৈতিক মাইলফলক নয়, বরং আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতীক। জাতিসংঘের স্বাধীন মূল্যায়ন প্রতিবেদন এই প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করবে বলে সরকারের আশা।
#বাংলাদেশ #এলডিসি_উত্তরণ #জাতিসংঘ #অর্থনীতি #উন্নয়ন #বাণিজ্য #ইআরডি #রপ্তানি #রাবাব_ফাতিমা #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















