২০২৫ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী—জাপানের শিমন সাকাগুচি, যুক্তরাষ্ট্রের মেরি ই. ব্রাংকো ও ফ্রেডরিক র্যামসডেল। তাঁদের যুগান্তকারী গবেষণায় উদঘাটিত হয়েছে শরীরের ‘নিয়ন্ত্রক টি কোষ’-এর রহস্য, যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিজ দেহকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখে।
নোবেলজয়ী গবেষণায় রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার রহস্য উদঘাটন
২০২৫ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী—জাপানের শিমন সাকাগুচি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মেরি ই. ব্রাংকো ও ফ্রেডরিক র্যামসডেল। তারা আবিষ্কার করেছেন শরীরের ‘নিয়ন্ত্রক টি কোষ’ বা Regulatory T Cells-এর কার্যপ্রণালি, যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিজ দেহকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখে। এই আবিষ্কার ক্যান্সার ও অটোইমিউন রোগের চিকিৎসা উন্নয়নে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার মূল প্রশ্ন
দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে দেহের কোষগুলো কীভাবে নিজেদের ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়? ১৯৮০-এর দশকে ‘সেন্ট্রাল টলারেন্স’ নামে একটি প্রক্রিয়া চিহ্নিত করা হয়, যেখানে দেহের নিজস্ব প্রোটিন চিনে ফেললে সেই টি কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। টি কোষ হলো শ্বেত রক্তকণিকার একটি প্রকার, যা সংক্রমণ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও জটিল। কিছু বিজ্ঞানী ধারণা করেছিলেন, দেহে এমন কিছু বিশেষ টি কোষ আছে, যারা অন্য টি কোষগুলোকে দেহ আক্রমণ করা থেকে বাধা দেয়। তবে ভুল গবেষণালব্ধ তথ্যের কারণে এই তত্ত্বটি পরে বাতিল করা হয়।
সাকাগুচির যুগান্তকারী আবিষ্কার
সবাই যখন এই ধারণা থেকে সরে আসছে, তখন শিমন সাকাগুচি ১৯৯৫ সালে তাঁর গবেষণায় দেখান, আসলে এক নতুন প্রকারের ‘নিয়ন্ত্রক’ টি কোষ আছে, যারা অন্য টি কোষগুলোর উপর নজরদারি করে। তিনি এই কোষগুলোকে ‘রেগুলেটরি টি সেল’ বা সংক্ষেপে Treg বলেন, আর এর কার্যপ্রণালি পরিচিত হয় ‘পেরিফেরাল টলারেন্স’ নামে।
পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ
সাকাগুচি নবজাতক ইঁদুরের থাইমাস গ্রন্থি (যেখানে টি কোষ তৈরি হয়) অপসারণ করে দেখেন, ইঁদুরগুলোতে অটোইমিউন রোগ দেখা দিচ্ছে—অর্থাৎ তাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের দেহকেই আক্রমণ করছে।
তিনি পরে সুস্থ ইঁদুরের টি কোষ সেই অসুস্থ ইঁদুরের শরীরে প্রবেশ করান। ফলাফল: নতুন ইঁদুরগুলো আর অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হলো না। এতে তিনি নিশ্চিত হন, এমন একটি বিশেষ ধরনের টি কোষ আছে, যা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার ভারসাম্য বজায় রাখে।

ব্রাংকো ও র্যামসডেলের সহযাত্রা
এই সময় আমেরিকান বিজ্ঞানী মেরি ই. ব্রাংকো ও ফ্রেডরিক র্যামসডেল ‘স্কারফি মাউস’ নামে এক প্রজাতির ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এদের ত্বক খসখসে, আয়ু কম এবং রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের শরীরকেই ধ্বংস করে ফেলে।
১৯৯০-এর দশকে তাঁরা আবিষ্কার করেন, এদের জিনে এক রহস্যজনক ত্রুটি আছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর তাঁরা খুঁজে বের করেন, FOXP3 নামের একটি জিনই এই অটোইমিউন রোগের মূল কারণ।
২০০১ সালে তাঁরা প্রকাশ করেন, এই FOXP3 জিনই স্কারফি মাউস ও মানুষের IPEX নামের রোগের জন্য দায়ী। দুই বছর পর সাকাগুচি দেখাতে সক্ষম হন, এই জিনই নিয়ন্ত্রক টি কোষের জন্ম ও কার্যপ্রণালিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর তাৎপর্য
এই আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, ক্যান্সার টিউমার অনেক সময় বিপুল পরিমাণ নিয়ন্ত্রক টি কোষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে, ফলে সাধারণ টি কোষগুলো ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে পারে না।
টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের রক্তক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. হাসমুখ জৈন বলেন, “যখন কোনো টিউমারে অনেক রেগুলেটরি টি সেল জমে, তখন তারা অন্যান্য টি সেলকে ক্যান্সার কোষ মারতে বাধা দেয়। নতুন ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপিগুলো এই বাধা ভাঙতেই কাজ করে—রেগুলেটরি টি সেলের প্রভাব কমিয়ে চিকিৎসার কার্যকারিতা বাড়ানো হয়।”

তিনি আরও জানান, এ ধরনের চিকিৎসায় কখনও কখনও রোগীর শরীরে অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বর্তমানে বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, যেখানে চেষ্টা করা হচ্ছে রেগুলেটরি টি কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে অটোইমিউন রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা যায় কি না। একইসঙ্গে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর অঙ্গ প্রত্যাখ্যান রোধে এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে।
ক্যান্সারের মতোই এখন গবেষকরা ল্যাবরেটরিতে টি কোষ পরিবর্তন করে রোগীর শরীরে ফেরত দিচ্ছেন, যাতে অতিসক্রিয় ইমিউন সিস্টেম শান্ত হয় এবং চিকিৎসা আরও কার্যকর হয়।
শিমন সাকাগুচি, মেরি ব্রাংকো ও ফ্রেডরিক র্যামসডেলের এই আবিষ্কার শুধু এক জটিল জীববৈজ্ঞানিক রহস্য উন্মোচন করেনি, বরং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন পথ তৈরি করেছে—যেখানে ইমিউন সিস্টেমের ভারসাম্যই ভবিষ্যৎ রোগনিরাময়ের মূল চাবিকাঠি।
#নোবেলপুরস্কার #চিকিৎসাবিজ্ঞান #রোগপ্রতিরোধব্যবস্থা #অটোইমিউন #ইমিউনোথেরাপি #রেগুলেটরি_টি_কোষ #শিমন_সাকাগুচি #বিজ্ঞান_বিশেষ_রিপোর্ট #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















