০৮:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
সপ্তাহের শেষ দিনে বড় ধস দেশের শেয়ারবাজারে হোকুসাইয়ের কন্যা: একটি অবহেলিত চিত্রশিল্পীর জীবনের চিত্রায়ন ওকায়ামা ইউমে রক্ষার জন্য নতুন পণ্য উদ্ভাবন বিজ্ঞানকে তহবিল দিন, ‘নতুন আইডিয়া জন্ম নেবে’ অপারেশন সিন্ধুর সাফল্যে ভারতের বিমানবাহিনীর কৌশলগত দক্ষতার উজ্জ্বল প্রমাণ পাকিস্তানে নতুন করে তীব্র হচ্ছে তালেবান বিদ্রোহ শীটাল দেবী: বিশ্বের সেরা আর্চার হিসেবে ফিরে আসা বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তায় নিরাপদ আশ্রয় স্বর্ণ: ডলার থেকে বিকল্প খুঁজছেন বিনিয়োগকারীরা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার মহামারি: কারণ,পরিসংখ্যান ও প্রতিরোধের পথ বিদেশে ভিসা পাওয়া ক্রমেই কঠিন হচ্ছে বাংলাদেশিদের জন্য

পতেঙ্গা থেকে দেশজুড়ে মব হিংসা: এক বছরে সহিংসতার নতুন ভয়াবহ রূপ

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় পুলিশের গাড়ি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে—বাংলাদেশে “মব হিংসা” বা জনতার হাতে বিচার এখন ভয়ঙ্কর এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। গত এক বছরে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা ইস্যুতে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনি ও মব আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সচেষ্ট থাকলেও সমাজে ন্যায়বিচারের প্রতি অনাস্থা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভ্রান্তিই যেন এই সহিংসতার মূল জ্বালানি হয়ে উঠছে।

পতেঙ্গা থেকে শুরু: পুলিশের ওপর জনতার হামলা

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা থানার কাটগড় এলাকায় এক দল লোক পুলিশের কাছ থেকে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনিয়ে নেয়।
ট্রাফিক কনস্টেবল নজরুল ইসলাম জব্দ করা অটোরিকশাটি নিজেই চালিয়ে আনছিলেন। এ সময় ৫০–৬০ জনের একটি দল লাঠি হাতে হামলা করে, গাড়ির কাচ ভেঙে দেয় এবং তাকে মারধর করে। পরে ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ট্রাফিক পরিদর্শক সেলিম খান বলেন, “গাড়িটি অবৈধভাবে চলাচল করছিল। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মব গঠন হয়, আক্রমণ করে ও গাড়িটি ছিনিয়ে নেয়।”
এ ঘটনায় নজরুল ইসলাম আহত হন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে আটক করে এবং মামলা দায়ের করে।

ঘটনাটি শুধু পুলিশের নিরাপত্তাই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনকে অমান্য করার প্রবণতা কতটা গভীরে পৌঁছেছে, সেটিও স্পষ্ট করে দেয়।

এক বছরের চিত্র: রাজনীতি থেকে ধর্মীয় উসকানি

পতেঙ্গা ঘটনা একক নয়। গত এক বছরে দেশজুড়ে অন্তত দুই ডজনের বেশি মব হিংসার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এসেছে—যেগুলোর বেশিরভাগই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট বা ভিডিও থেকে সূত্রপাত।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

২০২৪ সালের জুলাই থেকে শুরু হয় ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা। তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলন, ছাত্র-অভ্যুত্থান ও প্রতিরোধ কর্মসূচির সময় অনেক এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা থানায়, সরকারি দপ্তরে ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা চালায়।
উদাহরণস্বরূপ, হবিগঞ্জের বানিয়াচং থানায় একদল বিক্ষুব্ধ লোক পুলিশের ওপর হামলা চালায়—যা পরে “বানিয়াচং থানা হামলা মামলা” নামে আলোচিত হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ ‘ন্যায়বিচার পাবে না’—এই হতাশা থেকেই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।

ধর্মীয় বিদ্বেষ ও ভুয়া তথ্যের ফাঁদ

চট্টগ্রামের হাজি লেন এলাকায় একটি ফেসবুক পোস্ট ঘিরে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী মব গঠন করে দোকানপাট ভাঙচুর করে।
একইভাবে জানুয়ারি ২০২৫-এ চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে প্রান্ত তালুকদার নামে এক হিন্দু ব্যক্তিকে “ধর্ম অবমাননা”র অভিযোগে মব তুলে নিয়ে নির্যাতন চালায়। পরে সেই ভিডিও ভাইরাল হয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানায়।

সন্দেহভাজন চোরের ওপর গণপিটুনি

সাতকানিয়ায় চুরি সন্দেহে দুইজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। ঢাকায় তেজগাঁও, কামরাঙ্গীরচর ও গাবতলীতেও একাধিক গণপিটুনির খবর এসেছে। পুলিশের ভাষ্যমতে, এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও অধিকাংশের বিচার হয়নি।

কেন বাড়ছে মব হিংসা

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ প্রবণতা বাড়ার পেছনে সমাজের গভীর কয়েকটি ব্যর্থতা রয়েছে—

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভ্রান্তি: গুজব, ভিডিও ও ভুয়া পোস্ট থেকে মুহূর্তে জনরোষ তৈরি হয়। অনেক সময় কেউ ‘অপরাধী’ কিনা তা যাচাইয়ের আগেই মব বিচার শুরু হয়ে যায়।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা: দলীয় বিভক্তি ও প্রভাবশালী মহলের ছায়ায় স্থানীয় স্তরে মবকে ব্যবহৃত করা হয় প্রতিশোধমূলক অস্ত্র হিসেবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা: অনেক সময় পুলিশকে স্থানীয় চাপ, জনরোষ ও রাজনৈতিক নির্দেশনা মোকাবিলা করতে হয়। ফলে মাঠে দ্রুত হস্তক্ষেপ সম্ভব হয় না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল হান্নান বলেন, “মব হিংসা এখন কেবল অপরাধ নয়, এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর চিহ্ন। মানুষ আইনের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছে, আর সেটাই সবচেয়ে ভয়াবহ দিক।”

প্রভাব: ভয়অবিশ্বাস ও সামাজিক বিভাজন

এই হিংসার প্রভাব বহুমাত্রিক। সাধারণ মানুষ এখন কোনো সংঘর্ষের খবর শুনলেই ভিডিও করতে ছুটে যায়—সহায়তা নয়, বরং ‘মব’ দেখতে।
পুলিশও এখন প্রতিটি অভিযানে ‘ভিডিও হুমকি’ মাথায় রেখে কাজ করছে। ফলে প্রশাসনের আত্মবিশ্বাস ক্ষয়ে যাচ্ছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নতুন করে ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে; অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের পোস্ট মুছে ফেলছেন, পরিচয় গোপন রাখছেন।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, “বাংলাদেশে মব হিংসা, রাজনৈতিক দমননীতি ও সামাজিক প্রতিশোধের সংস্কৃতি মিলিয়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন গুরুতর ঝুঁকিতে।”

রাষ্ট্রীয় অবস্থান ও পুলিশের প্রতিক্রিয়া

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানিয়েছে, মব হিংসা রোধে পুলিশ সদর দফতরকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি থানাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় জনতার সঙ্গে সমন্বয় জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “মব গঠন বা জনতার হাতে নিপীড়ন আর সহ্য করা হবে না।”

তবে মাঠের বাস্তবতা এখনো কঠিন। স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রভাব, জনরোষ, এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া–সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বিশ্লেষণ: সমাজের সামনে কঠিন প্রশ্ন

মব হিংসা কেবল একটি আইনশৃঙ্খলা সমস্যা নয়; এটি সমাজের বিশ্বাস ও ন্যায়ের সংকটের প্রতিফলন।
যে সমাজে মানুষ আদালতের ওপর আস্থা হারায়, সেখানে ‘মব’ই হয়ে ওঠে অস্থায়ী বিচারক। কিন্তু সেই বিচারই পরিণত হয় অন্যায়ের প্রতীক হিসেবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—

  • প্রতিটি ঘটনার দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার জরুরি,
  • ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি জোরদার করা দরকার,
  • এবং স্থানীয় পর্যায়ে “কমিউনিটি পুলিশিং” ও সচেতনতা কার্যক্রম বাড়াতে হবে।

পতেঙ্গার ঘটনার পর চট্টগ্রামবাসী হয়তো কয়েকদিন আলোচনায় রাখবে এই সহিংসতা। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যাবে—এরপর?
যদি বিচার না হয়, যদি জনরোষের কারণগুলো অমীমাংসিত থাকে, তাহলে এই ‘মব শাসন’ আরও ছড়িয়ে পড়বে সমাজের প্রতিটি স্তরে।

বাংলাদেশকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সে কি আইনশাসনের পথে হাঁটবে, নাকি মবের হাতেই ন্যায়বিচার সমর্পণ করবে?

#মবহিংসা #চট্টগ্রাম #পতেঙ্গা #বাংলাদেশ #গণপিটুনি #আইনশৃঙ্খলা #সামাজিকসংকট #HumanRights #Police #সারাক্ষণরিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

সপ্তাহের শেষ দিনে বড় ধস দেশের শেয়ারবাজারে

পতেঙ্গা থেকে দেশজুড়ে মব হিংসা: এক বছরে সহিংসতার নতুন ভয়াবহ রূপ

০২:৫২:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় পুলিশের গাড়ি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে—বাংলাদেশে “মব হিংসা” বা জনতার হাতে বিচার এখন ভয়ঙ্কর এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। গত এক বছরে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা ইস্যুতে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনি ও মব আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সচেষ্ট থাকলেও সমাজে ন্যায়বিচারের প্রতি অনাস্থা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভ্রান্তিই যেন এই সহিংসতার মূল জ্বালানি হয়ে উঠছে।

পতেঙ্গা থেকে শুরু: পুলিশের ওপর জনতার হামলা

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা থানার কাটগড় এলাকায় এক দল লোক পুলিশের কাছ থেকে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনিয়ে নেয়।
ট্রাফিক কনস্টেবল নজরুল ইসলাম জব্দ করা অটোরিকশাটি নিজেই চালিয়ে আনছিলেন। এ সময় ৫০–৬০ জনের একটি দল লাঠি হাতে হামলা করে, গাড়ির কাচ ভেঙে দেয় এবং তাকে মারধর করে। পরে ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ট্রাফিক পরিদর্শক সেলিম খান বলেন, “গাড়িটি অবৈধভাবে চলাচল করছিল। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মব গঠন হয়, আক্রমণ করে ও গাড়িটি ছিনিয়ে নেয়।”
এ ঘটনায় নজরুল ইসলাম আহত হন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে আটক করে এবং মামলা দায়ের করে।

ঘটনাটি শুধু পুলিশের নিরাপত্তাই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনকে অমান্য করার প্রবণতা কতটা গভীরে পৌঁছেছে, সেটিও স্পষ্ট করে দেয়।

এক বছরের চিত্র: রাজনীতি থেকে ধর্মীয় উসকানি

পতেঙ্গা ঘটনা একক নয়। গত এক বছরে দেশজুড়ে অন্তত দুই ডজনের বেশি মব হিংসার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এসেছে—যেগুলোর বেশিরভাগই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট বা ভিডিও থেকে সূত্রপাত।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

২০২৪ সালের জুলাই থেকে শুরু হয় ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা। তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলন, ছাত্র-অভ্যুত্থান ও প্রতিরোধ কর্মসূচির সময় অনেক এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা থানায়, সরকারি দপ্তরে ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা চালায়।
উদাহরণস্বরূপ, হবিগঞ্জের বানিয়াচং থানায় একদল বিক্ষুব্ধ লোক পুলিশের ওপর হামলা চালায়—যা পরে “বানিয়াচং থানা হামলা মামলা” নামে আলোচিত হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ ‘ন্যায়বিচার পাবে না’—এই হতাশা থেকেই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।

ধর্মীয় বিদ্বেষ ও ভুয়া তথ্যের ফাঁদ

চট্টগ্রামের হাজি লেন এলাকায় একটি ফেসবুক পোস্ট ঘিরে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী মব গঠন করে দোকানপাট ভাঙচুর করে।
একইভাবে জানুয়ারি ২০২৫-এ চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে প্রান্ত তালুকদার নামে এক হিন্দু ব্যক্তিকে “ধর্ম অবমাননা”র অভিযোগে মব তুলে নিয়ে নির্যাতন চালায়। পরে সেই ভিডিও ভাইরাল হয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানায়।

সন্দেহভাজন চোরের ওপর গণপিটুনি

সাতকানিয়ায় চুরি সন্দেহে দুইজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। ঢাকায় তেজগাঁও, কামরাঙ্গীরচর ও গাবতলীতেও একাধিক গণপিটুনির খবর এসেছে। পুলিশের ভাষ্যমতে, এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও অধিকাংশের বিচার হয়নি।

কেন বাড়ছে মব হিংসা

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ প্রবণতা বাড়ার পেছনে সমাজের গভীর কয়েকটি ব্যর্থতা রয়েছে—

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভ্রান্তি: গুজব, ভিডিও ও ভুয়া পোস্ট থেকে মুহূর্তে জনরোষ তৈরি হয়। অনেক সময় কেউ ‘অপরাধী’ কিনা তা যাচাইয়ের আগেই মব বিচার শুরু হয়ে যায়।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা: দলীয় বিভক্তি ও প্রভাবশালী মহলের ছায়ায় স্থানীয় স্তরে মবকে ব্যবহৃত করা হয় প্রতিশোধমূলক অস্ত্র হিসেবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা: অনেক সময় পুলিশকে স্থানীয় চাপ, জনরোষ ও রাজনৈতিক নির্দেশনা মোকাবিলা করতে হয়। ফলে মাঠে দ্রুত হস্তক্ষেপ সম্ভব হয় না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল হান্নান বলেন, “মব হিংসা এখন কেবল অপরাধ নয়, এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর চিহ্ন। মানুষ আইনের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছে, আর সেটাই সবচেয়ে ভয়াবহ দিক।”

প্রভাব: ভয়অবিশ্বাস ও সামাজিক বিভাজন

এই হিংসার প্রভাব বহুমাত্রিক। সাধারণ মানুষ এখন কোনো সংঘর্ষের খবর শুনলেই ভিডিও করতে ছুটে যায়—সহায়তা নয়, বরং ‘মব’ দেখতে।
পুলিশও এখন প্রতিটি অভিযানে ‘ভিডিও হুমকি’ মাথায় রেখে কাজ করছে। ফলে প্রশাসনের আত্মবিশ্বাস ক্ষয়ে যাচ্ছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নতুন করে ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে; অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের পোস্ট মুছে ফেলছেন, পরিচয় গোপন রাখছেন।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, “বাংলাদেশে মব হিংসা, রাজনৈতিক দমননীতি ও সামাজিক প্রতিশোধের সংস্কৃতি মিলিয়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন গুরুতর ঝুঁকিতে।”

রাষ্ট্রীয় অবস্থান ও পুলিশের প্রতিক্রিয়া

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানিয়েছে, মব হিংসা রোধে পুলিশ সদর দফতরকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি থানাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় জনতার সঙ্গে সমন্বয় জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “মব গঠন বা জনতার হাতে নিপীড়ন আর সহ্য করা হবে না।”

তবে মাঠের বাস্তবতা এখনো কঠিন। স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রভাব, জনরোষ, এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া–সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বিশ্লেষণ: সমাজের সামনে কঠিন প্রশ্ন

মব হিংসা কেবল একটি আইনশৃঙ্খলা সমস্যা নয়; এটি সমাজের বিশ্বাস ও ন্যায়ের সংকটের প্রতিফলন।
যে সমাজে মানুষ আদালতের ওপর আস্থা হারায়, সেখানে ‘মব’ই হয়ে ওঠে অস্থায়ী বিচারক। কিন্তু সেই বিচারই পরিণত হয় অন্যায়ের প্রতীক হিসেবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—

  • প্রতিটি ঘটনার দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার জরুরি,
  • ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি জোরদার করা দরকার,
  • এবং স্থানীয় পর্যায়ে “কমিউনিটি পুলিশিং” ও সচেতনতা কার্যক্রম বাড়াতে হবে।

পতেঙ্গার ঘটনার পর চট্টগ্রামবাসী হয়তো কয়েকদিন আলোচনায় রাখবে এই সহিংসতা। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যাবে—এরপর?
যদি বিচার না হয়, যদি জনরোষের কারণগুলো অমীমাংসিত থাকে, তাহলে এই ‘মব শাসন’ আরও ছড়িয়ে পড়বে সমাজের প্রতিটি স্তরে।

বাংলাদেশকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সে কি আইনশাসনের পথে হাঁটবে, নাকি মবের হাতেই ন্যায়বিচার সমর্পণ করবে?

#মবহিংসা #চট্টগ্রাম #পতেঙ্গা #বাংলাদেশ #গণপিটুনি #আইনশৃঙ্খলা #সামাজিকসংকট #HumanRights #Police #সারাক্ষণরিপোর্ট