বাংলাদেশে মোটরসাইকেল এখন স্বাধীনতার প্রতীক নয়, বরং আশঙ্কার নাম। প্রতি বছর হাজারো তরুণ প্রাণ হারাচ্ছেন এই দুই চাকার যানে। দ্রুতগতি, প্রশিক্ষণের অভাব ও দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা—সব মিলিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এখন এক নীরব মহামারিতে পরিণত হয়েছে।
এক রাতেই তিন মৃত্যু, প্রশ্ন সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে
চট্টগ্রামে এক রাতের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু—দুই মোটরসাইকেল আরোহী ও এক পথচারী—দেশের ক্রমবর্ধমান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা সংকটের নতুন উদাহরণ। ফৌজদারহাট–পোর্ট লিংক রোড এবং আকমল আলী লিংক রোডের এই দুটি দুর্ঘটনা কেবল স্থানীয় নয়, বরং জাতীয় এক সমস্যার প্রতিফলন: বাংলাদেশের সড়কে মোটরসাইকেল যেন মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হচ্ছে।
দ্রুতগতি, অপ্রশিক্ষিত চালক ও সড়ক সংস্কৃতির অভাব
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের প্রায় ৬৫ শতাংশই মোটরসাইকেল। এই বিপুল সংখ্যক বাইক চালকের একটি বড় অংশই নবীন বা অনভিজ্ঞ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল চালানোর আগে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। চালকরা হেলমেট বা সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার না করে দ্রুত গতিতে চলাচল করেন এবং ট্রাফিক সিগন্যাল বা নিয়ম উপেক্ষা করেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শহরের অপর্যাপ্ত আলোকসজ্জা, অসমতল রাস্তা ও বৃষ্টির সময় পিচ্ছিলতা—যা প্রাণঘাতী পরিস্থিতি তৈরি করে।
‘দুই চাকার স্বাধীনতা’ থেকে বেপরোয়া সংস্কৃতি
বিশ্লেষকরা মনে করেন, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মোটরসাইকেল এখন শুধু পরিবহনের মাধ্যম নয়, বরং এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস প্রতীক’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বা রিল তৈরির প্রবণতা, বন্ধুদের সঙ্গে রেস করা বা রাতের অন্ধকারে নির্জন রাস্তায় দ্রুত গতিতে চলা—এসব এখন মোটরসাইকেল সংস্কৃতির অন্ধকার দিক হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেটসহ বড় শহরগুলোতে রাতে গতি সীমা অমান্য করে বাইক চালানোর প্রবণতা বেড়েছে। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বহুগুণে বাড়ছে।
পরিসংখ্যানে ভয়াবহ বাস্তবতা
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ২০২৫ সালের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২,৫০০ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১০ জনের বেশি মানুষ এই দুই চাকার যানবাহনের কারণে মারা যাচ্ছেন। নিহতদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ।
বিশ্লেষণ বলছে, এসব দুর্ঘটনার প্রায় ৭০ শতাংশ ঘটে শহর ও শহরতলির সড়কে, যেখানে ট্রাফিক আইন প্রয়োগের দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
বাংলাদেশে মোটরসাইকেল চালকদের জন্য হেলমেট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও বীমা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে এগুলো মানার প্রবণতা অত্যন্ত কম। ট্রাফিক পুলিশ একাধিকবার অভিযান চালালেও তা সাময়িক প্রভাব ফেলছে মাত্র। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, সিসি ক্যামেরা নজরদারি এবং কঠোর জরিমানা ছাড়া দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
একইসঙ্গে, মোটরসাইকেল বিক্রয়ের সময় প্রশিক্ষণ সনদ বাধ্যতামূলক করা, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ট্রাফিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা এবং শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে নির্দিষ্ট ‘বাইক লেন’ তৈরির পরামর্শ দিচ্ছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
পথচারীরাও বিপন্ন
চট্টগ্রামের ঘটনাটি দেখিয়েছে, শুধু চালক নয়, পথচারীরাও এখন ঝুঁকির মুখে। দ্রুতগামী মোটরসাইকেল রাস্তায় হেঁটে চলা সাধারণ মানুষদের জন্যও আতঙ্কের কারণ। বিশেষ করে ফুটপাত দখল ও পার্কিং সংকটের কারণে পথচারীরা বাধ্য হয়ে মূল সড়কে হাঁটছেন, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সমাধানের পথ: প্রযুক্তি, শিক্ষা ও কঠোরতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্ঘটনা রোধে তিনটি ধাপ জরুরি—
প্রযুক্তি ব্যবহার: হেলমেট সেন্সর, জিপিএস ট্র্যাকিং, স্পিড মনিটরিং এবং ট্রাফিক ক্যামেরা ব্যবহারে কঠোরতা বাড়ানো।
শিক্ষা ও সচেতনতা: স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা শিক্ষা চালু করা।
আইন প্রয়োগ: লাইসেন্সবিহীন চালক ও বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
উপসংহার: সড়ক নয়, সংস্কৃতি বদলানো জরুরি
বাংলাদেশে মোটরসাইকেল কেবল একটি যানবাহন নয়, বরং একটি সামাজিক বাস্তবতা। তবে এই বাস্তবতাকে নিরাপদ করতে হলে শুধু সড়ক উন্নয়ন নয়, চালকের মানসিকতা ও সমাজের ট্রাফিক সংস্কৃতিও বদলাতে হবে।
চট্টগ্রামের এই রাতের দুর্ঘটনা আমাদের জন্য এক নির্মম সতর্কবার্তা—যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, একসময় ‘দুই চাকার স্বাধীনতা’ হয়ে উঠবে ‘দুই চাকার মৃত্যু’।
চট্টগ্রাম, মোটরসাইকেল_দুর্ঘটনা, সড়ক_নিরাপত্তা, ট্রাফিক_আইন, পথচারী_দুর্ঘটনা, বাংলাদেশ_সংবাদ, সারাক্ষণ_রিপোর্ট