স্বর্ণের অস্বাভাবিক উত্থান
২০২৫ সালে স্বর্ণের দাম ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যদিও এবার কোনো আর্থিক ধস বা বৈশ্বিক মন্দা এর কারণ নয়। আগস্টে ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দেওয়ার পর থেকেই বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও বিকল্প সম্পদ কিনতে শুরু করেন। মঙ্গলবার স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে প্রথমবারের মতো ৪,০০০ ডলার ছাড়ায়, আর বুধবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪,০৪৩.৩০ ডলারে।
‘ডিবেসমেন্ট ট্রেড’ ও বিকল্প সম্পদের উত্থান
বিনিয়োগকারীরা এখন ডলার ও প্রধান মুদ্রাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। ফলে তাঁরা স্বর্ণ, বিটকয়েনসহ নানা বিকল্প সম্পদে ঝুঁকছেন, যা ওয়াল স্ট্রিটে ‘ডিবেসমেন্ট ট্রেড’ নামে পরিচিত।
এখন পর্যন্ত স্বর্ণের ফিউচার ৫২ শতাংশ বেড়েছে—যা কোভিড-১৯ মহামারি কিংবা ২০০৭–০৯ সালের মন্দাকালীন উত্থানের চেয়েও বেশি। কেবল ১৯৭৯ সালের মুদ্রাস্ফীতির সময় এমন উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল।
ট্রাম্পের করনীতি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জোয়ার
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর ছাড় দিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার ঘোষণা দিয়েছেন, আর এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–নির্ভর শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের উন্মাদনা শেয়ারবাজারকে নতুন উচ্চতায় ঠেলে দিয়েছে।
তবে একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি, নীতিগত অচলাবস্থা ও সরকারি অচলাবস্থা নিয়ে উদ্বেগও বাড়ছে। ফলে অনেকেই ডলারের পরিবর্তে অন্যান্য মুদ্রায় নির্ধারিত সম্পদে বিনিয়োগ করছেন।
বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় আস্থার টানাপোড়েন
ভ্যানগার্ড গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ জো ডেভিস বলেন, “একদিকে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক এআই-ভিত্তিক প্রবৃদ্ধির আশা করছে, অন্যদিকে স্বর্ণের ক্রেতারা বলছেন—যুক্তরাষ্ট্রে কাঠামোগত ঘাটতি ও রাজস্বচাপ তৈরি হচ্ছে, এবং সে ঝুঁকি মোকাবিলায় স্বর্ণই নিরাপদ।”
বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বিগত কয়েক বছর ধরে রিজার্ভে স্বর্ণ কিনছে, বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর থেকে। এতে স্বর্ণ এখন ইউরোর পর দ্বিতীয় বৃহত্তম রিজার্ভ সম্পদে পরিণত হয়েছে।
ডলারের দুর্বলতা ও ফেডের নীতিগত পরিবর্তন
২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতি ডলারকে গত পাঁচ দশকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় ঠেলে দেয়। পরবর্তীতে কিছুটা স্থিতিশীলতা এলেও আগস্টে পাওয়েলের বক্তৃতার পর স্বর্ণের দাম আবার বেড়ে যায়।
তিনি ইঙ্গিত দেন, শ্রমবাজারে মন্দার লক্ষণ এড়াতে ফেড সুদের হার কমানো শুরু করবে। ট্রাম্প প্রশাসন আরও বড় কাটছাঁটের পক্ষে, যাতে অর্থনীতিকে “গরম” রাখা যায়। এতে দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা বেড়ে সরকারি বন্ডের ফলনও বাড়ছে।
বিটকয়েনের নতুন রেকর্ড
‘ডিজিটাল স্বর্ণ’ নামে পরিচিত বিটকয়েনও ২০২৫ সালে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। সোমবার এটি ১,২৫,০০০ ডলারেরও বেশি ছুঁয়েছে, যা নতুন রেকর্ড। বুধবার কোইনডেস্ক সূচকে এর মূল্য দাঁড়ায় ১,২৩,৪৯৩.১৩ ডলার।
একই সময়, শেয়ারবাজারে আশাবাদী বিনিয়োগকারীরাও নিরাপত্তার কৌশল হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছেন। সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে স্বর্ণনির্ভর এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফান্ডে (ETF) রেকর্ড ৩৩ বিলিয়ন ডলার ঢুকেছে।
স্বর্ণে আস্থার প্রত্যাবর্তন
ব্ল্যাকরক সম্প্রতি তাদের বিনিয়োগ মডেলে স্বর্ণের অংশ বাড়িয়েছে, যদিও এআই ও ইকুইটিতেও বিনিয়োগ ধরে রেখেছে।
সিটাডেল সিকিউরিটিজের প্রতিষ্ঠাতা কেন গ্রিফিন বলেন, “বিনিয়োগকারীরা এখন স্বর্ণকে সেই নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে দেখছেন, যেভাবে একসময় ডলারকে দেখা হতো—এটাই সবচেয়ে উদ্বেগজনক।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমি আমেরিকান ব্যবসায় বাজি ধরব, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌম ঝুঁকি থেকে নিজেকে সুরক্ষিতও রাখব।”
বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব
ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে দেশটির সরকারি বন্ডের ফলন বেড়েছে, যুক্তরাজ্যে বাজেট ঘাটতি সামলাতে কর বাড়ানো বা ব্যয় কমানোর আশঙ্কায় দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের হার উচ্চ পর্যায়ে আছে।
জাপানে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি সুদের হার কমাতে ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ নিতে চান, ফলে ইয়েনের মান ডলারের বিপরীতে কমেছে।
স্বর্ণের সম্ভাবনা ও ঝুঁকি
গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগতভাবে ধারণ করা যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডের মাত্র ১ শতাংশ যদি স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়, তাহলে স্বর্ণের দাম বেড়ে প্রতি আউন্সে ৫,০০০ ডলারের কাছাকাছি যেতে পারে।
তারা মন্তব্য করেছে, “স্বর্ণ এমন একটি সম্পদ যার মূল্য প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থার পরিবর্তে নিজস্ব স্থায়িত্বে নির্ভর করে।”
তবে ব্যাংক অব আমেরিকার বিশ্লেষণে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ১৮৬০ সালের পর থেকে প্রতিটি দীর্ঘমেয়াদি স্বর্ণ উত্থানের পর বড় ধরনের পতন ঘটেছে।
বাজারের উত্তেজনা ও আশঙ্কা
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে ট্রাম্পের ফেড নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা বাধার মুখে পড়বে, বাজারে অস্থিরতা থেকে যাচ্ছে।
অ্যানেক্স ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ ব্রায়ান জ্যাকবসেন বলেন, “ট্রেডাররা এখন গল্পকে অনেক দূর পর্যন্ত ঠেলে দিচ্ছেন। কিন্তু একবার সেই গল্প পাল্টে গেলে, তরঙ্গও ভেঙে পড়ে।”
১৯৭৯ সালের স্বর্ণ উত্থানের পর ১৯৮২ সালের মধ্যভাগেই সব মুনাফা উধাও হয়ে গিয়েছিল—ইতিহাস আবারও সেই সতর্কবার্তা দিচ্ছে।
#স্বর্ণবাজার #ডলারপতন #বিটকয়েন #ফেডারেলরিজার্ভ #যুক্তরাষ্ট্রঅর্থনীতি #গ্লোবালবিনিয়োগ #ওয়ালস্ট্রিট #ট্রাম্পনীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট