১২:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫

পাকিস্তানে নতুন করে তীব্র হচ্ছে তালেবান বিদ্রোহ

সীমান্ত অঞ্চলে সহিংসতার পুনরুত্থান

আফগানিস্তানের সীমান্তঘেঁষা পাকিস্তানের বাজাউর জেলায় আবারও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। পাকিস্তানি তালেবান ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার পরিবার অস্থায়ী আশ্রয়ে দিন কাটাচ্ছে।

কঠিন পার্বত্য অঞ্চলে তালেবান জঙ্গিরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে। এটি গত এক দশকে পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।


পুনরায় জেগে ওঠা তালেবান হুমকি

চার বছর আগেও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এখন আবার সংগঠিত ও শক্তিশালী। আফগানিস্তানের তালেবান সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ পেয়ে তারা সীমান্তপারে অবাধে যাতায়াত করছে—এমন অভিযোগ পাকিস্তানি সামরিক সূত্র ও জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের। তবে কাবুলের তালেবান সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের গবেষক আসফানদিয়ার মির বলেন, “পাকিস্তানি তালেবান এখন নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছে, আর শক্তির ভারসাম্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিপরীতে ঝুঁকছে।”


সামরিক অভিযান ও স্থানচ্যুত মানুষের দুর্ভোগ

কাইবার-পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নতুন অভিযানে নামে গত গ্রীষ্মে। ড্রোন হামলা ও লক্ষ্যভিত্তিক অভিযানে অনেক জঙ্গিকে হত্যা করা হলেও স্থানীয় মানুষ আবারও যুদ্ধের শিকার হয়েছেন। স্কুল ভবনগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চগুলো সরিয়ে রাখা হয়েছে বাস্তুচ্যুত পরিবারের জন্য।

বাজাউরের এক ফেরিওয়ালা আব্দুল রহিম বলেন, “প্রতিবার সরকার অভিযান চালায়, আমরা ঘরছাড়া হই, আর জঙ্গিরা সীমান্ত পার হয়ে আফগানিস্তানে পালায়; পরে আবার ফিরে আসে।”


পাকিস্তানি সেনার ক্ষতি ও নিরাপত্তা সংকট

এই দমন অভিযানে শত শত সেনা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সামরিক বাহিনী। কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়েছে জনঅসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তজুড়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) সদস্যরাও সক্রিয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক পরাশক্তি হিসেবে পাকিস্তানের অবস্থান এখন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। এ বছর দেশটি সৌদি আরবের সঙ্গে নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে, ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, এবং সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন—তবু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট কাটছে না।


২০০৭-এর উত্তরাধিকার ও বর্তমান বাস্তবতা

২০০৭ সালে পাকিস্তানের মার্কিনবিরোধী অবস্থান থেকে জন্ম নেয় টিটিপি। তারা এক সময় শরিয়া আইন জারি করে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ ও সরকারি দপ্তরে হামলা চালায়। তবে মার্কিন ড্রোন হামলা ও পাকিস্তানি সেনা অভিযানে সংগঠনটি দুর্বল হয়ে পড়ে।

২০১৮ সালে ইসলামাবাদ সরকার ঘোষণা দেয়, টিটিপি প্রায় নির্মূল। কিন্তু ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর সংগঠনটি আবার জেগে ওঠে। তারা বিভিন্ন ভাঙা গোষ্ঠীকে একীভূত করে, আল-কায়েদার স্থানীয় শাখাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং মার্কিন সেনাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র—ড্রোন, স্নাইপার রাইফেল, নাইট গগলস—ব্যবহার করছে।


নতুন কৌশল ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বেগ

বিশ্লেষক পার্ল পান্ড্যা বলেন, “টিটিপি এখন সরাসরি সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণে বেশি মনোযোগী। পাকিস্তান সরকার পূর্ণমাত্রার অভিযান এড়িয়ে চলছে, কিন্তু স্থানীয় অসন্তোষেরও সুষ্ঠু সমাধান দিচ্ছে না। এভাবে বিচ্ছিন্ন অভিযানে দীর্ঘমেয়াদে সফল হওয়া কঠিন।”

একই সঙ্গে আফগানিস্তানের মাটিতে টিটিপির অবাধ চলাচল পাকিস্তানের ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী বলেন, “আমাদের একটাই অনুরোধ—আফগানিস্তানের মাটি যেন পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে ব্যবহার না হয়।”


সীমান্তবাসীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

বাজাউর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আবারও সংঘর্ষের ছায়া নেমেছে। এক দশক আগের মার্কিন ড্রোন হামলায় যে অঞ্চলে শত শত মানুষ নিহত হয়েছিল, সেখানে আজও নতুন প্রজন্ম যুদ্ধের ভয় নিয়ে বড় হচ্ছে।

আব্দুল রহিম বলেন, “২০০৬ সালে আমার গ্রামে ড্রোন হামলায় অনেক মানুষ মারা যায়। পরে যখন ফিরে আসি, দেখি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন আবার সেই ভয় ফিরেছে।”

বর্তমানে তিনি জানেন না কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, কিংবা ফেরার পর আদৌ বাড়ি থাকবে কি না। পাকিস্তানি সেনা এখনো তাদের অভিযানের সময়সীমা ঘোষণা করেনি, আর স্থানীয়দের জীবনে ঝুলছে নতুন অনিশ্চয়তার কালো মেঘ।


দীর্ঘদিন পর পাকিস্তান আবারও সেই পুরনো সংকটে—তালেবান বিদ্রোহ, সীমান্ত সংঘাত, এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা। আফগানিস্তান-নিয়ন্ত্রিত তালেবানের নীরব সমর্থন ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক দুর্বলতা মিলিয়ে এই সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।


 


#তালেবান #পাকিস্তান #আফগানিস্তান #টিটিপি #বাজাউর #দক্ষিণএশিয়া #নিরাপত্তাসংকট #সারাক্ষণরিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

পাকিস্তানে নতুন করে তীব্র হচ্ছে তালেবান বিদ্রোহ

০৭:০২:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫

সীমান্ত অঞ্চলে সহিংসতার পুনরুত্থান

আফগানিস্তানের সীমান্তঘেঁষা পাকিস্তানের বাজাউর জেলায় আবারও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। পাকিস্তানি তালেবান ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার পরিবার অস্থায়ী আশ্রয়ে দিন কাটাচ্ছে।

কঠিন পার্বত্য অঞ্চলে তালেবান জঙ্গিরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে। এটি গত এক দশকে পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।


পুনরায় জেগে ওঠা তালেবান হুমকি

চার বছর আগেও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এখন আবার সংগঠিত ও শক্তিশালী। আফগানিস্তানের তালেবান সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ পেয়ে তারা সীমান্তপারে অবাধে যাতায়াত করছে—এমন অভিযোগ পাকিস্তানি সামরিক সূত্র ও জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের। তবে কাবুলের তালেবান সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের গবেষক আসফানদিয়ার মির বলেন, “পাকিস্তানি তালেবান এখন নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছে, আর শক্তির ভারসাম্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিপরীতে ঝুঁকছে।”


সামরিক অভিযান ও স্থানচ্যুত মানুষের দুর্ভোগ

কাইবার-পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নতুন অভিযানে নামে গত গ্রীষ্মে। ড্রোন হামলা ও লক্ষ্যভিত্তিক অভিযানে অনেক জঙ্গিকে হত্যা করা হলেও স্থানীয় মানুষ আবারও যুদ্ধের শিকার হয়েছেন। স্কুল ভবনগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চগুলো সরিয়ে রাখা হয়েছে বাস্তুচ্যুত পরিবারের জন্য।

বাজাউরের এক ফেরিওয়ালা আব্দুল রহিম বলেন, “প্রতিবার সরকার অভিযান চালায়, আমরা ঘরছাড়া হই, আর জঙ্গিরা সীমান্ত পার হয়ে আফগানিস্তানে পালায়; পরে আবার ফিরে আসে।”


পাকিস্তানি সেনার ক্ষতি ও নিরাপত্তা সংকট

এই দমন অভিযানে শত শত সেনা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সামরিক বাহিনী। কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়েছে জনঅসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তজুড়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) সদস্যরাও সক্রিয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক পরাশক্তি হিসেবে পাকিস্তানের অবস্থান এখন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। এ বছর দেশটি সৌদি আরবের সঙ্গে নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে, ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, এবং সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন—তবু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট কাটছে না।


২০০৭-এর উত্তরাধিকার ও বর্তমান বাস্তবতা

২০০৭ সালে পাকিস্তানের মার্কিনবিরোধী অবস্থান থেকে জন্ম নেয় টিটিপি। তারা এক সময় শরিয়া আইন জারি করে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ ও সরকারি দপ্তরে হামলা চালায়। তবে মার্কিন ড্রোন হামলা ও পাকিস্তানি সেনা অভিযানে সংগঠনটি দুর্বল হয়ে পড়ে।

২০১৮ সালে ইসলামাবাদ সরকার ঘোষণা দেয়, টিটিপি প্রায় নির্মূল। কিন্তু ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর সংগঠনটি আবার জেগে ওঠে। তারা বিভিন্ন ভাঙা গোষ্ঠীকে একীভূত করে, আল-কায়েদার স্থানীয় শাখাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং মার্কিন সেনাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র—ড্রোন, স্নাইপার রাইফেল, নাইট গগলস—ব্যবহার করছে।


নতুন কৌশল ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বেগ

বিশ্লেষক পার্ল পান্ড্যা বলেন, “টিটিপি এখন সরাসরি সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণে বেশি মনোযোগী। পাকিস্তান সরকার পূর্ণমাত্রার অভিযান এড়িয়ে চলছে, কিন্তু স্থানীয় অসন্তোষেরও সুষ্ঠু সমাধান দিচ্ছে না। এভাবে বিচ্ছিন্ন অভিযানে দীর্ঘমেয়াদে সফল হওয়া কঠিন।”

একই সঙ্গে আফগানিস্তানের মাটিতে টিটিপির অবাধ চলাচল পাকিস্তানের ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী বলেন, “আমাদের একটাই অনুরোধ—আফগানিস্তানের মাটি যেন পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে ব্যবহার না হয়।”


সীমান্তবাসীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

বাজাউর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আবারও সংঘর্ষের ছায়া নেমেছে। এক দশক আগের মার্কিন ড্রোন হামলায় যে অঞ্চলে শত শত মানুষ নিহত হয়েছিল, সেখানে আজও নতুন প্রজন্ম যুদ্ধের ভয় নিয়ে বড় হচ্ছে।

আব্দুল রহিম বলেন, “২০০৬ সালে আমার গ্রামে ড্রোন হামলায় অনেক মানুষ মারা যায়। পরে যখন ফিরে আসি, দেখি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন আবার সেই ভয় ফিরেছে।”

বর্তমানে তিনি জানেন না কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, কিংবা ফেরার পর আদৌ বাড়ি থাকবে কি না। পাকিস্তানি সেনা এখনো তাদের অভিযানের সময়সীমা ঘোষণা করেনি, আর স্থানীয়দের জীবনে ঝুলছে নতুন অনিশ্চয়তার কালো মেঘ।


দীর্ঘদিন পর পাকিস্তান আবারও সেই পুরনো সংকটে—তালেবান বিদ্রোহ, সীমান্ত সংঘাত, এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা। আফগানিস্তান-নিয়ন্ত্রিত তালেবানের নীরব সমর্থন ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক দুর্বলতা মিলিয়ে এই সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।


 


#তালেবান #পাকিস্তান #আফগানিস্তান #টিটিপি #বাজাউর #দক্ষিণএশিয়া #নিরাপত্তাসংকট #সারাক্ষণরিপোর্ট