বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা কিংবা ব্যবসায়িক সফরের ভিসা পাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। কেবল কাগজপত্রের ঘাটতি নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও ধর্মীয় উগ্রপন্থা বৃদ্ধির আশঙ্কাও এই সংকটকে গভীর করছে।
ভিসা প্রত্যাখ্যান নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার উদ্বেগ
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, তিনিও “ভিসা প্রত্যাখ্যানের এই প্রবণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন”। তাঁর মতে, এর জন্য শুধু বিদেশি দূতাবাস নয়, বাংলাদেশের নাগরিকদেরও দায় রয়েছে।
“আমরা অনেক সময় ভুয়া কাগজপত্র দিই, আবার অনেকেই অনিয়মিতভাবে বিদেশে অবস্থান করেন। এর ফলে আমাদের সামগ্রিক সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে,” বলেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, জার্মানির মতো দেশে শিক্ষার্থীদের আবেদন বিপুল হারে জমা পড়ছে—কিন্তু প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা সীমিত। জার্মান রাষ্ট্রদূতের উদ্ধৃতি দিয়ে উপদেষ্টা জানান, “৮০ হাজার আবেদন জমা পড়েছে, অথচ তারা বছরে দুই হাজার কেসই সামলাতে পারেন।”
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির প্রভাব
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের ভিসা সংকট শুধুই প্রশাসনিক নয়; এটি দেশের আন্তর্জাতিক ইমেজের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, আল জাজিরা, ডয়চে ভেলে ও আরও বহু বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যমে বাংলাদেশের “রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মানবাধিকার সংকট ও ধর্মীয় উগ্রপন্থা বৃদ্ধির” বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ ও কার্নেগি এন্ডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস জানিয়েছে—বাংলাদেশে “মধ্যপন্থী ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে” এবং “ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান” বিদেশি মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
এই ইমেজের প্রভাব পড়ছে ভিসা নীতিতেও। যুক্তরাষ্ট্রের “ভিসা রেস্ট্রিকশন পলিসি” ইতিমধ্যেই কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ইউরোপের কিছু দেশ (যেমন বেলজিয়াম) বাংলাদেশ থেকে নতুন ভিসা আবেদন সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছে বলেও জানা গেছে।
শিক্ষার্থী ভিসা: বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বাধা
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা এখন অনেক সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাজ্যের হোম অফিসের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের “স্পনসর্ড স্টাডি ভিসা” ইস্যু প্রায় ১৪ শতাংশ কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশি আবেদনকারীদের ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার ৪৬ শতাংশেরও বেশি—দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।
শিক্ষার্থীরা জানাচ্ছেন, আগের মতো সহজে সাক্ষাৎকার পাস করা যাচ্ছে না। আর্থিক প্রমাণপত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অফার লেটার’ থাকা সত্ত্বেও ভিসা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনে তিনটি বড় কারণ কাজ করছে—
১. অসম্পূর্ণ বা ভুয়া তথ্য প্রদান
২. আবেদনকারীর “স্থায়ী থাকার” আশঙ্কা
৩. দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে দূতাবাসের উদ্বেগ
এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমি সম্পূর্ণ বৈধভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, কিন্তু দূতাবাস সন্দেহ করল আমি পড়তে নয়, কাজ করতে যাচ্ছি।”
চিকিৎসার ভিসা: মানবিক দরজাও সঙ্কুচিত
চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশিদের জন্যও ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসা ভিসা ইস্যুতে কঠোরতা এনেছে।
ভারতের দিল্লি, চেন্নাই ও কলকাতার বেশ কয়েকটি হাসপাতাল জানিয়েছে, অনেক রোগীর মেডিকেল রিপোর্ট ও প্রাথমিক বুকিং থাকা সত্ত্বেও দূতাবাস থেকে সাক্ষাৎকারে বাধা বা বিলম্ব হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকিৎসা ভিসার এই সংকটের কারণ হলো—নিরাপত্তা যাচাই প্রক্রিয়ার জটিলতা, ভিসা অপব্যবহারের আশঙ্কা, এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের অতিরিক্ত সংখ্যা।
একজন ভিসা পরামর্শক বলেন, “চিকিৎসার জরুরি অবস্থা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় অনুমোদন আসে দেরিতে, ফলে জীবনহানির ঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি হয়।”
গালফ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের বাধা
বাংলাদেশের অন্যতম রেমিট্যান্স উৎস গালফ অঞ্চলেও ভিসা সংকট দেখা দিচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের নতুন অনলাইন যাচাই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য নিরাপত্তা যাচাই ও আর্থিক নিশ্চয়তার শর্ত কঠোর হয়েছে। সৌদি আরবও সাময়িকভাবে কিছু “ব্লক ওয়ার্ক ভিসা” স্থগিত করেছে।
ফলে, বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যা রেমিট্যান্স প্রবাহেও প্রভাব ফেলতে পারে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কিছু গালফ দেশ বাংলাদেশের “অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও ধর্মীয় অস্থিরতা”কেও বিবেচনায় নিচ্ছে।
বেলজিয়ামসহ ইউরোপে ভিসা আবেদন বন্ধের ধারা
সম্প্রতি বেলজিয়ামের দূতাবাস বাংলাদেশ থেকে নতুন ভিসা আবেদন গ্রহণ সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট পোর্টালও বন্ধ রয়েছে।
ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ সীমিত কোটার আওতায় আবেদন নিচ্ছে, যা পড়াশোনা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে—বিশেষ করে স্কলারশিপ বা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নিতে আগ্রহীদের জন্য।
বিশ্লেষকদের মতে, ইউরোপের এই কঠোরতা শুধুমাত্র প্রক্রিয়াগত নয়; বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মতপ্রকাশের সংকট এবং ভুয়া আবেদনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি—সবই তাদের আস্থা নষ্ট করেছে।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও দেশের দায়
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, “বিদেশি দেশগুলোকে দোষারোপের আগে নিজেদের ঘর গোছাতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের নাগরিকরা যদি সৎভাবে আবেদন করে এবং নিয়ম মেনে চলে, তবে অনেক সমস্যাই সমাধান হবে।”
তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, শুধু “সততা” যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশকে রাজনৈতিক স্থিতি, আইনের শাসন ও নাগরিক স্বাধীনতার দিক থেকেও ইতিবাচক বার্তা দিতে হবে।
কারণ, ভিসা শুধুই একটি নথি নয়—এটি একটি দেশের প্রতি “বিশ্বাসের ভোট”, আর সেই বিশ্বাস এখন ক্ষয়ে যাচ্ছে।
#বাংলাদেশ #ভিসাসংকট #শিক্ষার্থীভিসা #চিকিৎসাভিসা #গালফকর্মসংস্থান #বেলজিয়াম #আন্তর্জাতিকভাবমূর্তি #সারাক্ষণরিপোর্ট